কর্তা যে দোকানকে এলাকায় ঢুকতে দেবেন না বলে আন্দোলন করেছিলেন, বহুজাতিক সংস্থার সেই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকেই ‘ব্রাউন রাইস’ আর টাটকা ‘ইয়েলো বেল পেপার’ কিনে বেরোতে দেখা গেল গিন্নিকে। এক গাল হেসে মহিলা বললেন, “টিভিতে শেখা একটা বিলিতি পদ রাঁধব ভাবছিলাম। এক সঙ্গে ব্রাউন রাইস আর বেল পেপারটা পাচ্ছিলাম না।”
এক সময় বিস্তর আন্দোলন হয়েছিল। বহুজাতিক সংস্থাকে মফস্সলে ঢুকতে না দেওয়ার মিটিং-মিছিল-অবরোধ এখন আর নেই। সম্প্রতি শ্রীরামপুরে দু’টি শপিং মল খুলেছে। অথচ কয়েক বছর আগে যখন দুটি বহুজাতিক সংস্থা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলেছিল শ্রীরামপুরে, তখন তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। যাঁরা সেই আন্দোলন করেছিলেন, আজ তাঁরা কি বলছেন? ‘হুগলি চেম্বার অফ কমার্স’-এর যুগ্ম সম্পাদক সুব্রত বসু দাবি করেছেন, সে দিনের আন্দোলন যথার্থই ছিল। তাঁর দাবি, “এই সমস্ত বহুজাতিক সংস্থার স্টল মুষ্টিমেয় লোকের পক্ষে ভাল।” তাঁর বক্তব্য, “বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাই বাজারে জিনিসের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই কারণেই গত কয়েক বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু-হু করে বেড়েছে।” বহুজাতিক সংস্থাগুলির স্থানীয় লোকজন অবশ্য ব্যবসায়ীদের এই যুক্তি মানেন না। তাঁদের পাল্টা বক্তব্য, দাম বাড়ার কারণ ভিন্ন। তা ছাড়া, আন্দোলনকারীরা সেই সময় দাবি করেছিলেন বহুজাতিক সংস্থা এলে ছোট ব্যবসায়ীরা মার খাবেন। কিন্তু আদপে তা হয়নি। উত্তরপাড়াতেও জিটি রোডের ধারে গড়ে উঠেছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। একই দৃশ্য পাশের শহর হিন্দমোটরেও। পুজোর ভিড় উপচে পড়ছে সেই সব দোকানে। |
ব্যবসায়িক বিরোধিতার পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনও ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। বছর ছ’য়েক আগে রাজ্যের অন্য জায়গার মতো হুগলিরও কিছু শহরে বহুজাতিক সংস্থার শপিং মলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল বাম-শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক। এখন সেই আন্দোলন কোথায়? দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা রাজ্যের কৃষি বিপণন পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নরেন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “এই শপিং মলগুলোয় কৃষিজাত পণ্য বা সব্জির বিক্রি এখনও নামমাত্র। কৃষি উৎপাদন এবং বিপণন ব্যবস্থাকে বড় বড় কিছু সংস্থা যখন হাতের মুঠোয় নিয়ে নেবে, কৃষক এবং ছোট ব্যবসায়ীদের বিপদ আসবে তখনই।” নরেনবাবুর আশা, “ফের তখন মানুষই প্রতিবাদ করবেন।” সেই সময় শপিং মল বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল ফব-র যুব সংগঠন যুব লিগ। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অনির্বাণ চৌধুরীর গলায় অবশ্য অন্য সুর। তিনি বলেছেন, “আমরা বুঝেছি, শুধু একটা বা দু‘টো শপিং মলের সামনে বিক্ষোভে বিশেষ লাভ নেই। সেখানে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কথাও মাথায় রাখা দরকার। সামগ্রিক ভাবে আর্থিক উদার নীতির বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”
শপিং মল বিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূলও। বাম আমলের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের আনা একটি বিলের উপরে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় সংশোধনী এনেছিলেন শপিং মলের পক্ষে সওয়াল করে। যে জন্য তাঁকে ভর্ৎসনা করা হয়েছিল দলের তরফে। সংশোধনী প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়ে স্পিকারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাগাতার বলতেন, “শপিং মল খুড়োর কল।” ২০০৯-এর লোকসভা এবং ২০১১-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের ইস্তাহারেও সে কথা জ্বলজ্বল করছে! কিন্তু এখন মলের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে তৃণমূলের আন্দোলন নেই। বরং, মমতার জমানাতেই কৃষি-বাজারেরও দরজা খুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার ‘বৃহৎ কৃষক বাজার’ নামে একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছে যেখান থেকে বড় বিনিয়োগকারীরা সরাসরি চাষিদের থেকে ফল এবং সব্জি কিনতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা মুখ খুলতে নারাজ। শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতা অবশ্য মেনেছেন, “আমরা যে ঘোষিত নীতি এবং অবস্থান থেকে সরে আসছি, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এ নিয়ে দলে আলোচনা হয়নি।”
বস্তুত, একটা শপিং মল বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর যে এলাকায় প্রভাব ফেলতে পারে, সম্প্রতি তার সাক্ষী থেকেছে শ্রীরামপুর। সেখানে সম্প্রতি একটি শপিং মলের উদ্বোধনের দিন সেখানে ঢুকতে চাওয়া ক্রেতাদের ভিড় রাস্তায় নেমে এসেছিল। পরিস্থিতি এমন হয় যে, যানজট সামাল দিতে পুলিশকে আসরে নামতে হয়। স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর গৌরমোহন দে-র পর্যবেক্ষণ, “এই ধরনের শপিং মল আসায় এলাকায় খাবার দোকানের বিক্রি বেড়েছে। রিক্শাচালকেরাও বাড়তি পয়সার মুখ দেখছেন।” শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়ার মতো শহর আন্দোলনের বাধা কাটাতে পারলেও বৈদ্যবাটি অবশ্য এখনও পারেনি। বছর কয়েক আগে ফরওয়ার্ড ব্লক, তৃণমূল এবং ব্যবসায়ীদের একাংশের আন্দোলনে সেখানে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের দরজা খোলেনি। শহরের বর্তমান পুরপ্রধান তৃণমূলের অজয়প্রতাপ সিংহ অবশ্য বলেন, “ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা শপিং মল হলে শহরের চেহারা বদলে যায়, এটা সত্যি। দেশীয় যে কোনও সংস্থা শেওড়াফুলি বা বৈদ্যবাটিতে আসতে চাইলে, স্বাগত।” |