কয়লা বিক্রি করে এই প্রথম লাভের মুখ দেখল পশ্চিমবঙ্গ খনিজ উন্নয়ন নিগম।
পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার অভাবে গত চার দশক ধরে কোটি-কোটি টাকা লোকসান করেছে খনিজ নিগম। অবশেষে গত আর্থিক বছরে (২০১২-১৩) সাড়ে ৭ কোটি টাকা লাভ করেছে তারা। সংস্থার কর্তারা জানিয়েছেন, ২০১১-১২ আর্থিক বছর পর্যন্ত নিগমের মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি টাকা। নিগমের ইতিহাসে গত আর্থিক বছরে প্রথম লাভ হওয়ায় উৎসাহী হয়ে রাজ্যের শিল্প দফতর চলতি আর্থিক বছরে মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৫০ কোটি টাকা।
খনিজ উন্নয়ন নিগমের এই সাফল্যকে সরকার পরিবর্তনের সুফল হিসেবেই দাবি করছে মহাকরণ। সাফল্য ধরে রাখতে নিগমকে আরও চাঙ্গা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর অঙ্গ হিসাবেই নিগমের চেয়ারম্যান পদ থেকে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে অব্যাহতি দিয়ে আনা হচ্ছে অম্লান বসুকে। এখন তিনি সংস্থার ডেপুটি চেয়ারম্যান। নিগমের এই পরিবর্তন নিয়ে অবশ্য দু’রকম মত রয়েছে। প্রশাসনের একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছেন, শিল্পমন্ত্রীকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি তাঁর প্রতি অনাস্থাই দেখালেন না? কিন্তু সে প্রশ্ন উড়িয়ে প্রশাসনের বেশির ভাগ অংশ বলছেন, নিগম লাভে ফেরার পরেও মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই তার চেয়ারম্যানের প্রতি অনাস্থা দেখাবেন না। তাঁদের মতে, সংস্থার সর্বোচ্চ দায়িত্বে এক জন বিশেষজ্ঞকে আনার দরকার ছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেই কাজটিই করেছেন। শিল্পমন্ত্রী জানিয়েছেন, কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় খনিজ নিগমের মাথায় এক জন সর্বক্ষণের লোক থাকা দরকার হয়ে পড়ছিল। অম্লানবাবু সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত নির্বাচন। তাঁকে বাইরে থেকে আনতে হয়নি। আর এই নিগম তো তাঁরই শিল্প দফতরের অধীন।
মাটির নিচে গ্রানাইট, পাথরকুচি, চুনাপাথর-সহ অন্যান্য খনিজ পদার্থ তুলে তা বাজারে বিক্রি করার জন্য ১৯৭৩ সালে তৈরি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ খনিজ উন্নয়ন নিগম। সংস্থাটির হাতে রয়েছে পুরুলিয়ার পালসারা ও বামনিশালার গ্রানাইট ব্লক, বাঁকুড়ার বড়জোড়া, বর্ধমানের কুলটি, সীতারামপুর, ইছাপুর ও জগন্নাথপুরের কয়লা ব্লক এবং বীরভূমের পাঁচামি, হাটগোলা ও জেঠিয়ায় পাথর খাদান। সরকারের এক মুখপাত্র জানান, এতগুলো খনিজ এলাকা হাতে থাকায় গ্রানাইট, পাথর ও কয়লার ক্ষেত্রে প্রায় একচেটিয়া বাজার কব্জা করার সুযোগ ছিল নিগমের। কিন্তু পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার অভাবে তা ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে জন্মলগ্ন থেকেই লোকসানের বোঝা বাড়তে থাকে। শিল্প দফতরের এক কর্তা বলেন, “লোকসান করাটাই অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল সংস্থাটি। তবু বছর বছর ভর্তুকি দিয়ে গিয়েছে রাজ্য সরকার। এখন উল্টোপথে হেঁটে সামান্য হলেও লাভের মুখ দেখাটা নিশ্চয়ই সাফল্য।” সরকারি সংস্থা যে লাভ করতে পারে, এই বিশ্বাসটা তৈরি হওয়ায় এখন নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। নিগমের এক মুখপাত্র জানান, পুরুলিয়ার বেশ কয়েকটি গ্রানাইট ব্লক এত দিন পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। এ বার সেই গ্রানাইট তোলার কাজ শুরু হবে। কী করে এই সাফল্য এল?
প্রশাসনের কর্তারা জানান, এত দিন খনিজ পদার্থ বিক্রির ক্ষেত্রে কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যথেচ্ছাচার চলত। এক দিকে লাগামছাড়া চুরি হত, অন্য দিকে সঠিক দামও মিলত না। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে ২০১২ সালে সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন করে সরকার। ঠিক হয়, খনিজ বিক্রি করা হবে নিলামে। সরকারি কর্তাদের মতে, এতেই সুফল মিলেছে।
নিগম সূত্রে খবর, তাদের হাতে থাকা ৬টি কয়লাখনির মধ্যে ট্রান্স দামোদর (বড়জোড়া) খনি থেকে গত আর্থিক বছরে মোট ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টন কয়লা তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ লক্ষ ৬৫ হাজার টন কয়লা নিলাম ডেকে বিক্রি করেই লাভের মুখ দেখা গিয়েছে। এর বাইরেও এখানকার কয়লা ডিভিসি, ডিপিএল এবং ইসকো-কে বিক্রি করার চুক্তি করেছে নিগম। সংস্থার এক কর্তা জানান, নিগমের বাকি পাঁচটি খনি থেকে এখন কয়লা তোলা হয় না। সেগুলি বেসরকারি সংস্থাকে চুক্তিতে দেওয়া হয়েছে। খনিগুলিতে কাজ শুরু হলেই লাভের অঙ্ক বাড়বে। নিগমের হাতে থাকা গ্রানাইট ও কালো পাথর খাদান থেকেও মুনাফা করার পরিকল্পনা করছে নিগম। নিগমের লাভ করার কৃতিত্ব কার, তা নিয়ে অবশ্য চাপান-উতোরও শুরু হয়েছে। বাম আমলে দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান পদে থাকা সিপিএম নেতা নিখিল মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “ট্রান্স দামোদর (বড়জোড়া) কয়লা প্রকল্প গড়ে উঠেছিল আমাদের আমলে, ২০০৬-০৭ সালে। তার সুফল মিলছে এখন। এর থেকে বর্তমান সরকারের বাহবা নেওয়ার কোনও কারণ নেই।” এর জবাবে শাসক দলের এক নেতা বলেন, “ট্রান্স দামোদর খনি থেকে কয়লা তোলার কাজ শুরুই করতে পারেনি আগের সরকার। নতুন সরকারই সেই কাজ করে লাভের মুখ দেখিয়েছে।” |