পত্রিকা: দেবব্রত বিশ্বাস কী বলতেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মুম্বই পাড়ি দেওয়া নিয়ে? উনি বিদ্রোহ করেছিলেন বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধে, কিন্তু এতটা কি তাঁরও বরদাস্ত হত?
শান্তনু: রবীন্দ্রসঙ্গীতের বুক ফুলিয়ে ‘মুম্বই পাড়ি দেওয়া’ আমার হিন্দি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম অ্যালবাম ‘মুসাফির’ ও এ বছরের অ্যালবাম ‘দিওয়ানা’-র কাঁধে ভর দিয়েই। মোট কুড়িটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম ও সার্থক হিন্দি ভাবানুবাদ। অন্তরের গভীরতা দিয়ে কাজটি করেছেন সঙ্গীত গবেষক, ভাষা বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিক পণ্ডিত সুবীর চক্রবর্তী ঠাকুর (আমার সঙ্গীতগুরু)।
শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের ‘সোনার কণ্ঠতরী’তে চড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বহু যুগ আগেই ইংরেজি জগতে পাড়ি দিয়েছিল। আজ উনি বেঁচে থাকলে আমার এই সাহসী প্রয়াসের জন্য অবশ্যই আশীর্বাদ করতেন। উনি বিদ্রোহ করেছিলেন বিশ্বভারতীর কয়েক জন সংকীর্ণ মানসিকতাপূর্ণ স্বার্থান্বেষী মানুষের বিরুদ্ধে।
আমার এই কাজ দু’টো অবশ্যই রবীন্দ্রজগতে বিপ্লব। তবে অনেকটা রেনেসাঁ বা ইতালীয় সফিস্ট বা বাংলার রামমোহন-বিদ্যাসাগর-ডিরোজিও-দের ধাঁচে। আমার উদ্দেশ্য রুচিশীল পথে জাতীয় ভাষার মাধ্যমে দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে রবীন্দ্রগানকে পৌঁছে দেওয়া।
জাতীয় স্তরে পৌঁছে দেওয়ার বিপ্লবের আকার কখনওই ছোট মাপের হওয়া সম্ভব নয়। এক জন পূর্বসূরি রবীন্দ্রবিপ্লবী হিসেবে এক জন অনুজের এই রুচিশীল সাহসী প্রয়াসকে জর্জদা বরদাস্ত তো করতেনই, বরং অনুপ্রেরণাও জোগাতেন।
পত্রিকা: বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড-এর যে রেড লাইনটা এত দিন ছিল সেটা যে কালের নিয়মে উঠে গেল, তার ফলে কি উচ্ছৃঙ্খলতার আমদানি হয়েছে?
শান্তনু: শৃঙ্খলা থাকলে পাশাপাশি উচ্ছৃঙ্খলতা তো থাকবেই। দু’টোকে নিয়েই সমাজকে এগোতে হয়। তবে শৃঙ্খলার হাতেই শাসনভারকে দিতে হয়। তা না হলে সমাজ ধ্বংসের পথে এগোবে।
বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড-এর যে রেড লাইনটা এত দিন ছিল, সেটা কালের নিয়মে উঠে গেছে। ফলে অনেকটাই উচ্ছৃঙ্খলতার আমদানি হয়েছে। আমার বিপ্লব এই উচ্ছৃঙ্খলতার বিরুদ্ধেই।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও সে যুগের এক জন সমাজ-বিপ্লবী ছিলেন। আমার সঙ্গীত গুরু সুবীর চক্রবর্তী ঠাকুর রবীন্দ্র বংশধর সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বাংলা ভাষার ক্লাস করেছিলেন পোর্টব্লেয়ারের সে যুগের ‘রবীন্দ্র বাংলা বিদ্যালয়ে’। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে রবীন্দ্র দর্শনে, রবীন্দ্র চিন্তনে, প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা ও পরিমিতিবোধজনিত গাইডেন্স দেওয়া। |
পত্রিকা: রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই বিনোদনকে বিপণন আকারে জাতীয় স্তরে নিয়ে যাওয়াটা কত দূর সম্ভব? অর্থাৎ হিন্দি অনুবাদ করে?
শান্তনু: রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ‘বিনোদন ও বিপণন’ উভয় আকারেই জাতীয় স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু সেটা কখনওই আক্ষরিক হিন্দি অনুবাদের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আগে দু’এক জন এই ট্রানস্লেশন পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। সেগুলির জন্মলগ্নেই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছিল। আসলে ভাষার দৃষ্টিকোণ, ডিকশন, সুরচিন্তন, অলঙ্করণ, ছন্দপ্রকরণ সমস্ত বিষয়েই বাংলা গান ও হিন্দি গানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। একমাত্র রবীন্দ্র দর্শনের পথে জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য ষাটের দশকের পরিমার্জিত আবহ সঙ্গীতের প্রয়োগ, শক্তিশালী হিন্দি ভাবানুবাদ এবং ট্র্যাডিশনাল হিন্দি গায়ন প্রয়োগই ব্যবধান মুছে দিতে পারে।
হ্যাঁ, ভারতবর্ষের বিভিন্ন মানুষজনের অনুপ্রেরণায় আমার সংকলন সেই বাধাকে জয় করেছে।
পত্রিকা: আরও বাঙালি যাঁরা এখনকার শীর্ষস্থানীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, যেমন শ্রীকান্ত, শ্রাবণী, তোমার কি মনে হয় এঁদেরও হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত করা উচিত?
শান্তনু: হ্যাঁ। আপনি ঠিক ধরেছেন। যাঁরা এখানকার প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী যেমন শ্রীকান্তদা, শ্রাবণী তাঁরাও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জাতীয় স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। অবশ্য এটা সম্পূর্ণ ভাবে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী কোটি কোটি মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে চাইছেন। কিন্তু ভাষার কারণে গাইতে পারছেন না। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি ভাবানুবাদের অ্যালবাম (রবীন্দ্রগীত) বের করে যেতে হবে।
আমি শুরু করলাম, অন্যরাও এগিয়ে এলে ভারতবর্ষের মানুষ উপকৃতই হবেন।
পত্রিকা: অন্য রাজ্যে ‘বাঙালির হিন্দি’ নিয়ে হাসাহাসি হয়। বলাই হয় ‘বাঙালির হিন্দি’। এই উচ্চারণ সমস্যা কাটালে কী করে?
শান্তনু: বাঙালির মাতৃভাষা ‘বাংলা’। হিন্দিভাষীদের মাতৃভাষা ‘হিন্দি’। তাই অন্য রাজ্যে বাঙালির হিন্দি উচ্চারণ নিয়ে যেমন হাসাহাসি হয়, তেমনি একদম প্রথম দিকে ভারতীয় লঘু সঙ্গীতের মা সরস্বতী লতাজিকেও এই বাংলা উচ্চারণ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু নিষ্ঠা, অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই উনি বাংলা লঘু সঙ্গীতের জগতেও শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
একই কারণে আমাকেও প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার গুরুজির তত্ত্বাবধানে আমাকেও হিন্দি-উর্দু ভাষা চর্চা, গোয়ালিয়র ঘরানায় হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা, গীত, ভজন, গজল গাওয়া নিয়মিত ভাবে নিষ্ঠা সহকারে করতে হয়েছে।
পত্রিকা: ‘জেনারেশন ওয়াই’-এর কাছে পৌঁছনোর জন্য অনেক পারফর্মার নিজেদেরকে পরিবর্তন করে পৌঁছতে চায় তাদের কাছে। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত তো অনুভব ভিত্তিক। তাদের কাছে পৌঁছনোর জন্য কি আমি নিজেকে এতটা বদলাব? নাকি কিছুটা বদলে অপেক্ষা করব জেনারেশন ওয়াই-এর রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে আসার জন্য। এই আপস কতখানি?
শান্তনু: জেনারেশন ওয়াই-এর কাছে পৌঁছানো ব্যাপারটা কিন্তু খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় না যদি এক জন তাঁর ব্যক্তিগত রক্ষণশীল গোঁড়ামোর সংকীর্ণতা সুলভ কাঠিন্যের পরিমাণ খানিকটা কমাতে রাজি থাকেন। আর একটা হল ভ্রান্ত ‘ইগো’ সমস্যা। রবীন্দ্রনাথই আমাদের বলে গেছেন ‘ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’।
জেনারেশন ওয়াই-এর কাছে আমরা এক হাত বাড়িয়ে দিলে ওরাও আমাদের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দেবে। দুই জেনারেশনের মেলবন্ধন হবে। ‘পুরোনোর মধ্যে নতুন’ এই ট্র্যাডিশন সমানে চলতে থাকবে। এটাই তো কাম্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না, ‘হে নূতন যাক পুরাতন স্মৃতি’।
সুতরাং চিরকালই ‘নূতন-পুরাতন’-এর এই অন্তরের বন্ধনের মধ্য দিয়ে যুগ এগিয়েছে, এগোচ্ছে, এগোবে। এই বন্ধনের কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পত্রিকা: ‘দিওয়ানা’ এই অ্যালবামের হেডলাইন, এই দিওয়ানা অভিব্যক্তি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে যায় বলে তুমি মনে করো?
শান্তনু: অবশ্যই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জন ‘মুসাফির’ ছিলেন। এক জন ‘দিওয়ানা’ ছিলেন। এই ব্যাপারটি বিশ্বের প্রতিটি মানুষই বহু দিন আগেই জানেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা সমগ্র পড়লেই এই উপলব্ধি খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসবে। নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই আমার হিন্দি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম-এর নাম কখনও ‘মুসাফির’, এবারেরটা ‘দিওয়ানা’। সামনেরটা (হাসি)। এগুলো আগে শুনে ফেলুন, উপভোগ করুন, তার পরে ঠিক সময়েই জানতে পারবেন। একবার যখন ভারতবর্ষ পরিক্রমা শুরু হয়েছে, তখন পরিক্রমা চলতেই থাকবে। থামবে না। কবির ভাষায় বলা যাক ‘মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’। |