|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি ১... |
|
পুরনো কাসুন্দি আর ঘাঁটতে চাই না |
প্রসেনজিৎ থেকে রানি, রাজনীতি থেকে সাঁইবাবা...‘জীবে-প্রেম’। দেবশ্রী রায়-এর
সঙ্গে আড্ডা ঘুরে গেল অলি-গলি নানা পথে। সঙ্গী নিবেদিতা দে |
ফায়ার ব্রিগেডে আগে খবরটা দিন... আমি দেখছি অ্যাম্বুল্যান্স”... মোবাইলের এ প্রান্তে দেবশ্রী রায়... অপর প্রান্তে এক অসহায় মহিলা।
শেষে জানা গেল, আগুন নয়। মহিলার আর্তির কারণ এক হনুমান! টাওয়ারের তারে এমন ভাবে আটকে গেছে... তাই দেখেই আশঙ্কিত মহিলা ফোন করেছেন দেবশ্রীকে। আর সেই বিপদ থেকে উদ্ধারেই দেবশ্রীর এই তৎপরতা! অ্যাম্বুল্যান্স, ফায়ার ব্রিগেডের খোঁজ!!
এর আগে যত বার দেবশ্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, দেখেছি তার সারাক্ষণের সঙ্গী পোষ্য কুকুরটিকে...কিন্তু এই ভাবে নানা জায়গা থেকে আসা আবেদনে, নেত্রীর ভূমিকায়...এখন বিধায়ক তিনি। দায়িত্ব, উদ্যোগ সর্বজনীন তো হবেই! সুন্দরী নায়িকার পরিবর্তনের এমন রূপ দেখতে দেখতে তাই জানতে চাইলাম—
পত্রিকা: ভাল লাগে এই সব করতে? ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন’-এর নায়িকা...
দেবশ্রী: কী বলছেন! এই সব কাজ করতে গিয়ে কত রকমের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ভাবতে পারবেন না! সত্যি, মানুষ কত স্বার্থপর...আর ওই জীবজন্তুগুলো? কী অসহায়! জানেন, সামান্য সামান্য অসুখের জন্য এত দিনের পোষা কুকুরকে লোকে রাস্তায় ছেড়ে পালায়!
পোষ্যটা একদিন যাকে বাবা-মা ভাবল, সামান্য অসুখে, সে রাতারাতি ঘর-ছাড়া! ভাবতে পারি না। তাই অসহায় জীবজন্তুকে দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিই। এই তো ক’দিন আগে, কয়েকটা খরগোশকে পিটিয়ে মারা হল। পোস্টমর্টেম করালাম...
কথার মাঝেই ফের ফোন। কেউ মোষ বলি নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন দেবশ্রীকে। |
.............. |
|
ছবি: রানা বসু
মেকআপ: অর্পিতা গঙ্গোপাধ্যায় |
বুঝলাম, যে কথা জানতে এসেছি তাঁর কাছে...নায়িকা-নেত্রীর কাজের চাপে কিছুতেই বোধহয় জানা যাবে না না সে কথা। তাই আচমকাই বলে ফেললাম
পত্রিকা: একটা প্রশ্ন করি?
দেবশ্রী: বলুন।
পত্রিকা: গত শনিবার প্রসেনজিতের তিরিশ বছরের কর্মজীবন নিয়ে অনুষ্ঠান ছিল। ‘অপরাজিত প্রসেনজিৎ’। গেলেন না কেন?
দেবশ্রী: হে ভগবান! এটা প্রশ্ন হল?
পত্রিকা: বলুন না, গেলেন না কেন?
দেবশ্রী: (একটু থেমে) দরকারি কাজ পড়ে গিয়েছিল।
পত্রিকা: সত্যিই? নাকি...?
দেবশ্রী: মহা মুশকিল! আমি তো ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মরণসভাতেও যেতে পারিনি। পঞ্চায়েত মিটিং ছিল। দিদিকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বলেওছিলাম। দিদি বলেছিলেন, “ঠিক আছে।”...তা আমার সঙ্গে কথা বলতে এলে কি প্রসেনজিৎ-প্রসঙ্গ আনতেই হবে?
পত্রিকা: আনা যাবে না-ই বা কেন? প্রসেনজিতের ব্যাপারে এতই স্পর্শকাতর আপনি?
দেবশ্রী: তা নয়! আসলে পুরনো কাসুন্দি আর ঘাঁটতে চাই না। নিজেকে এখন অন্য ভাবে ছড়িয়ে ফেলেছি।
...আসলে সব কিছুরই একটা ফেজ থাকে, একটা পর্ব, পর্যায় থাকে... সমাজকল্যাণমূলক কাজে আজ আমি যে আনন্দ পাই, সেই আনন্দ কোনও সাধারণ, আজেবাজে চরিত্রে অভিনয় করে পাই না। আর অকারণে লোকের সঙ্গে কথা বলে, হেসে সময় নষ্ট করে তো নয়ই। তবে এই যে আমার নতুন ছবি ‘স্বভূমি’ রিলিজ করল, এই ধরনের কাজ করতে পারলে সত্যি ভাল লাগে।
পত্রিকা: তা আপনার কর্মজীবনও তো নয় নয় করে...
দেবশ্রী: হ্যাঁ...অ-নে-ক দিন। সেই এগারো মাস বয়সে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেছি। পাঁচ-ছ’বছরে ‘কুহেলী’, তার পর ‘নদী থেকে সাগরে’... তবে ‘দাদার কীর্তি’ (১৯৮০) থেকে ধরলে তা-ও তেত্রিশ বছরের নায়িকা-জীবন।
পত্রিকা: আচ্ছা বড়সড় অনুষ্ঠান করে নিজের কর্মজীবন সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে করে না?
দেবশ্রী: নাহ্। নিজের প্রচার করতে খুব খারাপ লাগে। প্রসঙ্গ পালটান প্লিজ! আমরা যে অসহায় জীবজন্তু নিয়ে আলোচনা করছিলাম, সেই কথায় ফিরি?
পত্রিকা: বেশ, বলুন। আপনি তো চিড়িয়াখানার একটা হাতি দত্তক নিয়েছেন শুনলাম!
দেবশ্রী: আইনি কাজটা এখনও বাকি আছে... আসলে কী জানেন? অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে পারলে যে আনন্দ হয়, যে তৃপ্তিটা পাই, সেটা অন্য কোনও ভাবে আর পাই না।
এই তো কিছু দিন আগেই একটা হেল্থ ক্যাম্প করলাম। রায়দিঘিতে। কত গরিব মানুষ আছেন, যাঁদের সিরিয়াস একটা অপারেশন দরকার, কিন্তু পয়সার অভাবে করতে পারছেন না, আমাকে ফোন করেন, আমি চেষ্টা করি তাঁর পাশে দাঁড়াতে। |
............. |
|
দেবশ্রীর সামনে বসে সামান্য সময়েই বুঝলাম, বছর তিনেক আগের দেবশ্রী আর আজকের দেবশ্রী রায় কত আলাদা। কথায় কথায় হেসে কুটিপাটি খেয়ে সোফায় গড়িয়ে পড়তেন যিনি, আজ সেই তিনিই এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে কথা পর্যন্তও বলতে পারেন না!
পত্রিকা: আচ্ছা, নায়িকা হিসেবে আপনি তো আজও অভিনয় করে যাচ্ছেন...তবুও আপনাকে ঠিক তেমন করে দর্শক পান না, কেন?
দেবশ্রী: (হেসে) ঠিক কেমন করে?
পত্রিকা: এই যেমন ধরুন, ঋতুপর্ণা। পর পর ছবি করছেন ...রোজ কোনও না কোনও ইভেন্টে, পার্টিতে, ম্যাগাজিনে, খবরের কাগজের পাতায় তাঁকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আপনাকে...
দেবশ্রী: সবাই কি এক রকম হয়? তা ছাড়া আমার একটা রাজনৈতিক-সত্তাও আছে। আমি অ্যানিম্যাল অ্যাক্টিভিস্ট।
কেবল মাত্র অভিনয় করলে না হয় কথা ছিল। পেশার কারণে অনেক সময় ইচ্ছে না হলেও যেতে হয় নানা জায়গায়। আমিও গেছি এক সময়ে। কিন্তু আজ আমি পালটে গেছি। আজ আমার মনে হয়, একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে চিংড়ি মাছে কামড় দিয়ে ছবি তোলার চেয়ে, দুটো মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে আমার বেশি ভাল লাগবে।
পত্রিকা: আচ্ছা, রানি মুখোপাধ্যায়েরও তো প্রসেনজিতের এই অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল। এলেন না তো?
দেবশ্রী: (হাসি)।
পত্রিকা: রানিও কিন্তু তেমন ছবি করছেন না...
দেবশ্রী: আমারই তো বোনঝি। ‘হ্যাঁ’-এর চেয়ে ‘না’ টাই বেশি বলে। যা হোক একটা কিছু করতে হবে বলে, কিছু করে ফেলব, এটা ওরও ভাল লাগে না।
যা করব, ভাল করে করব। নয়তো করবই না। খুব জোর গলায় বলতে পারি, আজও আমি ছবি করি আমার অভিনয়ের জোরে, কারও কাঁধে ভর দিয়ে নয়।
অন্যের নামে ছবি বিক্রি হল, আর সেই ছবিতে আমি টপ করে গিয়ে পড়লাম, তা হয় না আমার ক্ষেত্রে। তা ছাড়া আজকাল বেশির ভাগ ছবিরই যা অবস্থা! তৈরির আগেই ভাবতে হয়, কত দ্রুত স্যাটেলাইট রাইটস বিক্রি হবে, মিউজিক রাইটস বিক্রি হবে। তা ছাড়া প্রডিউসার ঠিক করা, নিজের চরিত্র ঠিক করা...অত পোষায় না। পিছনের পাতায় উত্তর দেখে নিয়ে প্রথম পাতার অঙ্ক করতে ভাল লাগে না। আনন্দও পাই না।
পত্রিকা: সেই জন্যেই কি আজ আপনার ছবি এত কম?
দেবশ্রী: হ্যাঁ, আজও পরিচালক, প্রযোজক ভাল ছবির অফার আনেন আমার কাছে। আমি সেই স্কুলিং-এই বিশ্বাসী। অজয় কর, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, সকলেই আমার অভিনয় দক্ষতা যাচাই করেই নিয়েছেন ছবিতে।
পত্রিকা: আচ্ছা, এখন প্রসেনজিতের সঙ্গে ছবির অফার এলে করবেন?
দেবশ্রী: (চোখ নামিয়ে) অনেকেই বলেন এ কথা। বিপ্লবদার (চট্টোপাধ্যায়) ছেলের বিয়েতে আমার মাকে অর্পিতাই (চট্টোপাধ্যায়) তো জিজ্ঞেস করেছে আমি ওঁর সঙ্গে ছবি করি না কেন?
পত্রিকা: কোথাও দেখা হলে অর্পিতার সঙ্গে কথা হয়?
দেবশ্রী: ও-ই অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেলে টুকটাক কথা হয়।...জানেন তো, যে বছর ‘সানন্দা তিলোত্তমা’ জিতেছিল অর্পিতা, সে বছর ওই অনুষ্ঠানের অন্যতম বিচারক ছিলাম আমি, ওই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় ওকে প্রশ্নটা আমিই করেছিলাম।
পত্রিকা: তো প্রসেনজিতের সঙ্গে ছবির অফার এলে করবেন?
দেবশ্রী: (হেসে)... ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে! আমরা শিল্পী...ভেবে দেখব! |
|
পত্রিকা: ঋতুপর্ণা-প্রসেনজিৎকে নিয়ে কিন্তু আবার ছবি তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। ওঁরা একসঙ্গে ফটোশু্যটও করেন।
দেবশ্রী: দেখুন, আমি তো শুধু ওঁর নায়িকাই ছিলাম না, আমার সঙ্গে প্রসেনজিতের একটা সম্পর্কও তো ছিল... (থেমে) সেই জন্যেই দ্বিধাটা হয়তো বেশি...ছেড়ে দিন, অন্য কথা বলুন। (একটু নীরব) আর ফটোশু্যট? আমি একা প্রচুর ফটোশ্যুট করি। আপনাদের প্রথম পাতায় যে ছবিটা, সেটাও একটা ফটোশ্যুটেরই ছবি।
পত্রিকা: সিঁদুর-টিপে আপনাকে দারুণ দেখাচ্ছে কিন্তু...
দেবশ্রী: অনেকে কী বলে জানেন? টিভির মহালয়ার জন্য ‘মা দুর্গা’ সাজে আমাকেই নাকি সব চেয়ে ভাল মানায় (হাসি)। আসলে পুজো মানেই বড় টিপ আর সিঁদুর।
পত্রিকা: আপনার নাচের ট্রুপ ‘নটরাজ’-এর কী খবর?
দেবশ্রী: প্র্যাকটিসের অভাবে শো করতে পারছি না, তবে নাচের ক্লাস চলছে। মাঝে অবশ্য ‘দিদি’র কথায় দু’টো শো করেছি।
পত্রিকা: দুমদাম ক’টা কথা জিজ্ঞেস করি?
দেবশ্রী: (হাসি) সবই তো দুমদাম করছেন।
পত্রিকা: রানি (মুখোপাধ্যায়) কি আদিত্য চোপড়াকে বিয়ে করছেন?
দেবশ্রী: সেটা বলা কি আমার উচিত হবে? তবে হ্যাঁ, আদিত্য খুব ভাল ছেলে। খুব ভাল। মিশুকে। গত বারের পুজোতেই তো দশমীর দিন জুহু বিচে রানিদের বাড়ির পুজোর ভাসান দিয়ে রানি, আমি এবং আরও সবাই মিলে খুব নেচেটেচে বাড়ি ফিরলাম। অনেক পরে আদিত্য (চোপড়া) এল। বৈভবী মার্চেন্ট (কোরিয়োগ্রাফার) এল। সারা রাত আড্ডা হল রানিদের বাড়িতে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। ভাল কথা, এ বছর প্রাণীদের ওয়েলফেয়ারের জন্য রানিদের পুজোয় আমার একটা শাড়ির স্টল থাকছে। সেই টাকাটা জীবজন্তুর সেবায় লাগবে।
পত্রিকা: আপনি সাঁইবাবার ভক্ত তো? বাড়িতে এখনও ভজন হয়?
দেবশ্রী: আমার বাড়িতে হয় না, তবে কেউ ভজন অর্গানাইজ করলে আমি যাই। জানেন, বিধানসভার ইলেকশনের ক্যাম্পেন করছি রায়দিঘিতে...হঠাৎ খবর এল ‘বাবা’ গত হয়েছেন। কী কান্না কেঁদেছি সানগ্লাসের আড়ালে। আমার সঙ্গে ছিলেন পূর্ণদাস বাউল। দিনের শেষে থাকতে পারিনি, পূর্ণদার কাছে ভেঙে পড়েছি। পুতাপুত্তি আশ্রমে উনিও তো যেতেন! সেই অর্থে উনি আমার গুরুভাই। কী সুন্দর একটা সোনার হার ওঁকে দিয়েছিলেন ‘বাবা’। সেই হার উনি পরে থাকেন সব সময়। ওই হার ছুঁয়েই সে দিন প্রণাম জানিয়েছিলাম। |
.......... |
|
কথার মাঝে হঠাৎই দেবশ্রীর অফিসঘরের দরজা ঠেলে ঢুকলেন দু’টি মেয়ে। এক ঝলক দেখেই চেনা চেনা মনে হল এক জনকে!
পত্রিকা: ভীষণ চেনা চেনা লাগছে...কোথায় দেখেছি বলুন তো?
দেবশ্রী: বৈশালী ডালমিয়া।
পত্রিকা: মানে জগমোহন ডালমিয়ার মেয়ে?
দেবশ্রী: হ্যাঁ।
পত্রিকা: উনি এখানে কী করছেন?
বৈশালীকে ডাকলেন দেবশ্রী। মিষ্টি হেসে চেয়ার টেনে বসলেন বৈশালী দেবশ্রীর পাশে।
দেবশ্রী: আমরা একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চলেছি এই বছরেই, তা-ই নিয়েই কথা বলতে এসেছে ও। বৈশালীও পশুপ্রেমী। আমি যেমন চিড়িয়াখানার একটা হাতি দত্তক নিয়েছি, তেমনই বৈশালী নিয়েছে একটা জাগুয়ার।
পত্রিকা: তাই? কী অনুষ্ঠান করছেন আপনারা দু’জনে মিলে?
বৈশালী: এখনই পুরোটা বলছি না, তবে টলিউড-বলিউড-বাংলাদেশের অনেকেই পারফর্ম করবেন। এখনই কারও নাম করতে চাইছি না। সেই কথা বলতেই এসেছি।
দেবশ্রী: পুরো অনুষ্ঠানটাই হবে প্রাণীদের জন্য। ওই যে বক্স আছে দেখুন, ফান্ডের জন্য ক্লাবে ক্লাবে রেখেছি।
দেবশ্রীর অফিস ঘরের এক কোণে রাখা সেই বাক্সের গায়ে চোখ পড়ল, যাতে লেখা, ‘জীবে প্রেম করে যে-ই জন, সেই জন....’। |
|
|
|
|
|