|
|
|
|
স্মরণ |
শরতে হেমন্ত ২৫ |
ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজে বিশ্বাসী ছিলেন না। রেকর্ডিং-এ সময় নিতেন নামমাত্র। শখ ছিল সাদা ফিয়েট গাড়ির,
আর এর-তার উপকার করে বেড়ানো। ২৬ সেপ্টেম্বর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পঁচিশ বছর। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার বাল্যবন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা বই-ই লিখে ফেলেছিলেন ‘হেমন্তর কী মন্তর’। প্রবীণ বয়েসেও কবি ঠাওরে উঠতে পারেননি, বন্ধুটির জাদুটা ঠিক কোথায়; গলায়, চেহারায়, মনে না হৃদয়ে? ওঁর জীবন সায়াহ্নে হেমন্তবাবুকে দিন-দিন দেখে আমাকেও যে এই ধন্ধে পড়তে হয়নি, তা নয়।
সুভাষদাকে বলতে উনি বললেন, “তুমি জানো, কী সমস্যায় আমাকে ফেললে হেমন্ত এক সময়? বলতে লাগল, ‘না, সুভাষ তোমার অবস্থার একটা বিহিত করতে হবে। এমন টাকা টানাটানির মধ্যে থাকা চলবে না।’ কথাবার্তায় বুঝলাম আমাকে ও বড়লোক করেই ছাড়বে। তখন ওকে থামানোর জন্য বললাম, ‘রোসো, রোসো, বাপু। এই তো দিব্যি চলে যাচ্ছে, তুমি আবার এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?’ তখন হেমন্ত কী বলল জানো? বলল, ‘তোমার অবস্থার ভাল দেখতে আমার ভাল লাগবে।’ এই হচ্ছে হেমন্ত।”
এই হেমন্তকে সব সময়ে চোখে পড়ে না। হাতা গোটানো সাদা ফুলশার্ট, ধুতি আর চপ্পলে নিপাট ভদ্র ইমেজ আর প্রবল খ্যাতির পিছনে হারিয়ে থাকা অপূর্ব ভালমানুষটি যথেষ্ট আলোয় আসেন না সব সময়। শুধু কি সুভাষদা, দুনিয়ার কত লোকেরই যে উপচিকীর্ষা মাথায় নিয়ে থুম হয়ে বসে থাকতেন টেবিলের এক পাশে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবার না। কে কখন আসবে, কার কী দরকার, কাকে কী দিতে হবে, এই সব ভাঁজছেন আর দিয়েও যাচ্ছেন।
একদিন বইয়ের কাজে কথা রেকর্ড করছি হেমন্তদার। হঠাৎ মাঝে থেমে একটু চুপ করে রইলেন। তার পর বসার ঘরের এক ধারে বসে কাকে একটা বললেন, “অজিতের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না ক’দিন। আসছেও না। একটা খবর করো তো।” বলেই সাক্ষাৎকারের যেখানে কথা ছেড়েছিলেন সেখান থেকেই ধরে নিলেন। যেন মাঝখানে ওটা একটা চায়ের অর্ডার করলেন মাত্র। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, তা হলে এই সব গানবাজনার কথার তলে তলে বন্ধু অজিত চট্টোপাধ্যায়ের অসুখের ভাবনাটাও চলাচল করছিল!
ব্যাপারটা প্রকট হল আরও কয়েক মাস পর যখন বই হচ্ছে। প্রকাশককে বললেন, “আমার এ বাড়িতে ছবিটবি কিসুই নেই। আমার কোনও রেকর্ডই নেই, বাজানোর যন্তরটাও বেকল। আমার স-ব ছবি অজিতের কাছে। ও-ই দেবে। তবে হ্যাঁ, ওকে কিছু টাকা দেবেন। এত কাল যত্ন করে রেখেছে।” |
|
হেমন্তদা নিজে যত্ন করে জিনিসপত্তর আগলাবার মধ্যে বড় একটা কোনও দিনই ছিলেন না। শেষ দিকে অসুখবিসুখে জেরবার হচ্ছিলেন যখন, তখন চিন্তায় পড়তেন গলাটা বাঁচানো নিয়ে। একদিন বললেন, “আমার গলার কিছু খারাপ দেখি না। সমস্যা হচ্ছে দম নিয়ে।”
এরকম আরেকটা আগলাবার জিনিস ওঁর ছিল। ওঁর সৎ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। খুব শ্লাঘার সঙ্গে একবার বলেছিলেন, “যখন বম্বে ছাড়লাম, তখন আমার বাজারে পঁয়তাল্লিশ লাখ টাকা দেনা, শেষের দিকের ক’টা ছবি না লেগে যা হল। আমি কিন্তু গেয়ে গেয়ে পাই-পয়সা অবধি মিটিয়ে দিয়েছি।”
শেষ দিন অবধি নিজের ধুতি শার্টের স্টাইল স্টেটমেন্টটা যে আগলে ছিলেন এটা কারও অজানা নয়। যেটা কম জানা তা হল, সাদা পোশাকের মতো সাদা ফিয়েট গাড়ির উপর নির্ভরতা। যেখানেই যান, যে কাজেই যান, নিজের ফিয়েটে করেই চলবেন, ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় পৌঁছবেন। সময়ের মাহাত্ম্য এত ছিল ওঁর কাছে যে গান রেকর্ড করার সময়ও অজস্র টেক-এর মধ্যে কখনও যেতেন না। বড়জোর দুটো কি তিনটে টেক। ব্যস!
এইচএমভি স্টুডিয়োয় ওঁর এরকম একটা টেক-এর পর জিজ্ঞেস করায় বললেন, “দ্যাখো, দুটো-তিনটের মধ্যে কাজটা দিতে না পারলে সারা দিনেও দিতে পারব না।”
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নাগাড়ে রিহার্সাল করারও পক্ষপাতী ছিলেন না। ওঁর এক প্রিয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্ল যখন রবিশঙ্কর ও আলি আকবর খানের সুরে বাংলা গান রেকর্ড করার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন হেমন্তদা হেসে মৃদু ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘তোমার পণ্ডিতজির পাল্লায় পড়লে তো, দ্যাখো কত রিহার্সাল, রিহার্সাল আর রিহার্সাল করান। বুঝবে ঠ্যালা!’
অল্প সময়ের মধ্যে নিজের সেরাটা বার করার এক অনায়াস দক্ষতা ছিল হেমন্তদা’র। পৃথিবীতে ওঁর এক সেরা ভক্ত চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারের কাছে এর এক নিপুণ বৃত্তান্ত শুনেছি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো তরুণবাবুও মনে করেন, হেমন্তবাবু মানুষটার কোনও তুলনা হয় না। তবে তাঁর সব ছবিতে হেমন্তবাবুকেই যে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চাইতেন তার কারণ ছবিতে সুর করার এমন এক সরল জনমোহিনী রকম ছিল হেমন্তর, যার কোনও বিকল্প নেই। তাই ‘পলাতক’-এর মতো পল্লিসুরাশ্রয়ী গানের ছবিতেও উনি পরিচালক চেয়েছিলেন হেমন্তবাবুকে।
তাতে গাঁইগুঁই করেছিলেন হেমন্তদাই। বলেছিলেন তিনি তো সেভাবে পল্লিগানের চর্চা করেন না, তাই ওই কাজে হাত দিতে ইতস্তত বোধ করছেন। বলা বাহুল্য, তরুণবাবু সে ওজর-আপত্তিতে কান দেননি। হেমন্তবাবু তখন এক নতুন ছেলেকে গীতিকার হিসেবে বেছে নেন। মুকুল দত্ত। আর গান সুর করা শুরু হবে যখন, তখন ঘাড়ের ব্যথায় হেমন্তবাবু ভরতি হলেন বম্বের নর্থকোট হসপিটালে।
সেই অবস্থাতেই এক আজব কাণ্ড চলল হাসপাতালে। মুকুল তাঁর লিরিক লিখে লিখে পাতা দিচ্ছেন হেমন্তকে আর সুরকার ওই শোওয়া অবস্থায় একটু ভেবে নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুর করে যাচ্ছেন কথায়। আর সেভাবেই ফলতে লাগল
‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই
কোনও দেশে সাকিন নাই
কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না’
এবং অন্য সব চিরমধুর গীতাঞ্জলি।
এই অল্প সময়ে সেরা সুর ফেঁদে ফেলার পিছনে কাজ করত হেমন্তদা’র ওই বিরল গোত্রের আত্মবিশ্বাস। যে-আত্মবিশ্বাসের একটা সুন্দর ছবি পাওয়া যাবে একটা ঘটনায়। বলছি ...
১৯৫৭-র ছবি ‘হারানো সুর’। তাতে সুর করতে বম্বে থেকে এসেছেন হেমন্ত। সুচিত্রার প্লে-ব্যাকে গাওয়ানের জন্য শিল্পী বেছেছেন গীতা দত্তকে। রেকর্ডিং করিয়েই স্টুডিয়ো থেকে গিয়ে বম্বের ফ্লাইট ধরবেন। কাজ সেরে উনি গাড়িতে উঠতে যাবেন, ওঁকে এগিয়ে দিতে গাড়ি অবধি এসেছেন পরিচালক অজয় কর ও প্রযোজক মশাই। দু’জনের মুখেই কীরকম একটা কিন্তু-কিন্তু ভাব। ওঁরা বুঝেই উঠতে পারছেন না গানটা কীরকম দাঁড়াল। একটু বেশি সোজা সোজা হয়ে গেল? অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছেন না, হেমন্ত মুখুজ্জে বলে কথা!
শেষে ব্যাপারটা আঁচ করে হেমন্তদাই মুখ খুললেন। ‘কিস্সু করার নেই এ গান নিয়ে। এ গান লাগবেই।’ বলে গাড়িতে উঠে রওনা দিলেন। ছবি রিলিজ হতেই হইহই করে লেগে গেল সুচিত্রার লিপে গীতার গান। আর আজও বাঙালি আনন্দাশ্রু বর্জন করছে এই গান শুনে।
‘তুমি যে আমার
ও গো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার।’
হেমন্তদা’র আত্মবিশ্বাসের দারুণ আরেকটা গল্প শুনেছি আরতি মুখোপাধ্যায়ের কাছে। এইচএমভি-র স্টুডিয়োতে ডুয়েট রেকর্ডিং করছেন হেমন্তদার সঙ্গে। হেমন্তদা তখন স্টেট এক্সপ্রেস ফাইভ ফিফটি ফাইভে চেন স্মোক করেন। রেকর্ডিং চেম্বারেও ওঁর জন্য অ্যাশ-ট্রে রাখা থাকে নিয়ম ভেঙেই।
তো আরতি বলছেন, “আমি দেখি কী, স্টুডিয়োর লাল বাতি জ্বলল। হেমন্তদা ঠোঁটের সিগারেটটা অ্যাশ-ট্রেতে নামিয়ে পারফেক্ট টিউনে ও পিচ-এ ধরে নিলেন গান। তার পর নিজের অংশটুকু গেয়ে আমায় ছেড়ে দিলেন। আমি তো ওঁর ওই সিগারেট রেখে গান ধরা দেখে তাজ্জব বনে গেছি। যা হোক, নিজের পার্টটা যখন গাইছি ফের দেখি হেমন্তদা সিগারেট ধরে ফেলেছেন। আমি তখন ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠছি। এ বার তো আমায় ছাড়তে হবে, তখন...কী বলব জানেন, আমি তো আমার জায়গা মতো ছাড়লাম, আর কী দেখলাম? হেমন্তদা দিব্যি সুখটান শেষ করে, ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেটটা ছাইদানিতে রেখে, ফের নিজের জায়গায় গান ধরে নিয়ে কী সুরে অবলীলায় গেয়ে গেলেন! কী কনফিডেন্স ভাবুন, আর গলার কী কন্ট্রোল!”
আর এই গলাকে ধরে রাখার জন্য হেমন্তদা’র রেওয়াজ ছিল কোনও রকম রেওয়াজের মধ্যে না-যাওয়া। কলকাতার বাইরে জলসায় গাইতে গেছেন, অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে হৈমন্তী শুক্লও আছেন। আমায় বললেন হৈমন্তী, ‘বিশ্বাস করবেন না, হেমন্তদার রেওয়াজ কী দেখলাম জানেন সকালে? হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসে বাচ্চাদের মতো প্যাঁ প্যাঁ করে রিড টিপে দু’বার সারে গামাপাধানিসা /সানিধাপামাগারেসা করে হারমোনিয়ামটা পাশে সরিয়ে রেখে বললেন, ‘ব্যস, হয়ে গেল।’ তার পর সন্ধেবেলায় যে কী অপূর্ব গাইলেন সে আর কী বলব! তখন কে বলবে এই গানের রেওয়াজ হয়েছে ওই ভাবে!”
যে লোকটা বহুত কিছু ধরে রাখার মধ্যে ছিলেন না, তাঁর একটা জিনিস ছাড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছে দেখেছিলাম। সিগারেট। হৃদরোগের কারণে শেষ দিকে তো ওঁকে চেয়ারে বসিয়ে ফ্ল্যাটে তোলা আর নামানো হত; সিগারেট নিষেধ হয়েছিল অনেক আগেই। ফলে মগজে একটু ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য নস্যি ধরেছিলেন। তাতে ওই রোম্যান্টিক কণ্ঠস্বরে ঈষৎ আনুনাসিকতা এসে যেত কখনও কখনও। নস্যি নেওয়া নিয়ে অনুযোগ করাতে এক দিন আমায় বললেন, “কী করব বলো, সিগারেটটা তো ছাড়তেই হচ্ছে, নস্যিটা নিয়ে সামলাচ্ছি। জানি এতে একটা নেজাল টোন এসে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। তবে ও ঠিক আছে। গেয়ে তো দিচ্ছি।”
তবু শেষ দিন অবধি সিগারেটের টানটা থেকে গিয়েছিল। আমি কাজের জন্য ওঁর ওখানে গেলে এক ফাঁকে আমায় ঢুকিয়ে নিতেন ফ্ল্যাটের গোড়ার বাঁ-হাতের ঘরটায়। তার পর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বলতেন, “দাও তোমার একটা সিগ্রেট দাও। তুমিও খাও। এই ডাক্তারি নিষেধের ঠেলায় আর পারি না। একটু তো রিলিফ হবে। যাকগে কাউকে বোলো না...।” |
|
ছবি: পরিমল গোস্বামী |
আমি সোৎসাহে বলতাম, “না, না, খান খান। দিনে একটায় কিস্যু ক্ষতি করবে না।” কী করবে না করবে জানতাম না, তবে এত বড় একটা মানুষের এই সরল, বালকোচিত আকাঙ্ক্ষায় প্রশ্রয় দিয়ে বড় ভাল লাগত। মনে হত পুণ্য করছি। সিগারেটে টান দিয়ে ওঁর সেই আমোদের ধোঁয়া ছাড়া দেখব বলে আমি সাধ্যের বাইরে গিয়েও দামি সিগারেট সঙ্গে রাখতাম। উনি কিন্তু সেই ব্র্যান্ড-ট্র্যান্ডের দিকেও দৃকপাত করতেন না। ওঁর সামান্য একটু ধোঁয়া হলেই আরাম। কেবল যেদিন ‘আমার গানের স্বরলিপি’-র উদ্বোধন হল প্রেস ক্লাবের বাগানে, উনি আমার একটা জন প্লেয়ার স্পেশাল টেনে বড় তৃপ্তির সঙ্গে বলেছিলেন, “বাঃ, বেশ খেতে। তুমি আজ আমায় আরেকটা দিতে পারো। বাড়িতে নিয়ে খাব।”
আমি গোটা প্যাকেটটাই ওঁকে দিতে চেয়েছিলাম। উনি কিছুতেই নিলেন না। বললেন, “লিমিট থাক। লোভ করলেই সর্বনাশ।”
আজ এত দিন পরে ওঁর কথাটা ওঁর নিজের চরিত্রেরই একটা সূক্ষ্ম বর্ণনা বলে মনে হয়। এত পরিমিতি বোধ খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি জীবনে। লোককে দেয়াথোওয়াতেই শুধু লিমিট দেখিনি। আর ওঁর ওই স্বর্গীয় গানের প্রতিভাতে। বাঁধনছাড়া আর একটা তৃতীয় দিকের কথাও বলতে হয় তা হলে। তা হল ‘যাকগে! যাকগে!’ করে যে-কোনও মনখারাপ-করা ব্যাপারকে ময়লার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করা। কত নির্মম, অবান্তর সমালোচনা বেরিয়েছে ওঁর কাগজে। ভুলক্রমে একবারও রিপিট একবারও সে প্রসঙ্গ উঠতে দেননি কথাবার্তায়। কেন রিঅ্যাক্ট করেন না, এই প্রশ্নও তাই ওঁকে করতে হয়েছিল একবার। তাতে উনি লেখক বিমল মিত্রের একটা পরামর্শের উল্লেখ করেছিলেন। বললেন, “কাগজে নিন্দেমন্দ গাইছে শুনে বিমলবাবু বললেন, ‘আনন্দ করুন! আনন্দ করুন! সমালোচনা, নিন্দেটিন্দে হচ্ছে মানে আপনার নাম হচ্ছে। নামযশের ওর চেয়ে ভাল দাড়িপাল্লা হয় না’।”
সমালোচনা না হয় গায়ে মাখতেন না। তা বলে প্রশংসাতেও কি খুব টলে যেতেন হেমন্তদা? এক্কেবারেই না। একটা ঘটনা বলি তা হলে। ক্যাসেটের শারদ সম্ভারের উদ্বোধন আয়োজন করেছিল সাউন্ড উইং সংস্থা দক্ষিণ কলকাতার পল ম্যানসনে, ’৮৭ কী ’৮৮ সালে। একটা সোফায় সুচিত্রা মিত্রের পাশে বসে নানা ক্যাসেটের গান শুনছিলাম। একেবারে শেষে ওরা বাজাল ‘সত্তর দশকের হেমন্ত’ নামের ক্যাসেট থেকে ‘কৃষ্ণকলি’ গানটা।
সাউন্ড সিস্টেমে গানটা আসতেই গোটা ঘরে পিন পড়া নিস্তব্ধতা। কুড়ি-পঁচিশ জন অতিথির সবাই কী রকম মন্ত্রমুগ্ধ সহসা। ‘কৃষ্ণকলি’র এহেন স্বপ্নিল রেন্ডারিং তো জীবনে কেউ শোনেনি। গান যত এগোচ্ছে আমি দেখছি সুচিত্রাদির চোখ দু’টো জলে ভরে আসছে। হাজার হোক গানটা তো শান্তিদেব আর ওঁর নামের সঙ্গেই জুড়ে আছে এত দিন। সেখানে নতুন এক অবতারের জন্ম হচ্ছে একেকটা পঙ্ক্তি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। গান শেষ হতে উনি চোখ চাপা দিয়ে পাশের একটা ঘরে গিয়ে বসে পড়লেন। ওঁর আনন্দাশ্রুও উনি কারও সামনে নিক্ষেপ করতে চাইছিলেন না।
আমি বাড়ি ফিরে এসেই ফোন করেছিলাম হেমন্তদাকে। কিন্তু হেমন্তদা’ হেমন্তদা’ই। সব শুনে বললেন, “তোমার এত ভাল লেগেছে?” স্পষ্ট বুঝলাম প্রশংসা ওঁকে সঙ্কোচে ফেলছে। তার পর বললেন, “ওটা সুচিত্রার প্রিয় গান। তাই গাই না। ও গান ওরই থাক। তোমরা আমার ক্যাসেটটা শুনো।”
একটা বড় মানুষ যে কত ভালমানুষ হতে পারে তার দুই উদাহরণের একটি থেকে গেলেন হেমন্তদা। অন্য উদাহরণ সত্যজিৎ রায়। এঁদের লম্বা লম্বা চেহারাগুলো এঁদের ভেতরকার মহত্ত্বেরই হাড়মাংস ছবি। বহিরঙ্গ। প্রায় গায়ে গায়ে সময়ে জন্মেছিলেন ১৬ জুন ১৯২০ আর ২ মে ১৯২১। চলেও গেলেন গায়ে গায়ে ১৯৮৯ আর ১৯৯২। তার পর থেকে কলকাতা আর ভাল নেই। যেটুকু ভাল থাকা তা একজনের গান শুনে আর আরেকজনের ছবি দেখে। |
|
|
|
|
|