খদ্দের নেই, বিপাকে ফ্লাই অ্যাশ ইট উৎপাদকেরা
রাজ্যের প্রায় ৩৫টি কারখানায় নিয়মিত উৎপন্ন হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই বা ‘ফ্লাই অ্যাশ’ দিয়ে তৈরি ইট। কিন্তু সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সরকারি নির্মাণ প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে না এই ইট। আগ্রহ নেই বেসরকারি আবাসন বা নির্মাণ সংস্থাগুলির তরফেও। ফলে লক্ষ লক্ষ টাকার ইট পড়ে নষ্ট হচ্ছে ফ্লাই অ্যাশ ইট কারখানাগুলিতে। ফ্লাই অ্যাশ ইট প্রস্তুতকারকদের একটি সংগঠন তাই এ বিষয়ে সরকারি দফতরগুলির সঙ্গে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করছে আগামী মঙ্গলবার, দুর্গাপুর সিটি সেন্টারের সৃজনী প্রেক্ষাগৃহে।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই পরিবেশ দূষণ করে। কিন্তু তা থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তৈরি-করা ইট যদি নির্মাণের কাজে লাগানো যায়, তা হলে ওই বর্জ্য দ্রব্যের যথাযথ ব্যবহার হবে, নির্মাণের খরচ কমবে, সাবেকি ইট তৈরির জন্য উর্বর মাটির ব্যবহারও কমানো যাবে। এই সব সুবিধের কথা মাথায় রেখেই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির কাছাকাছি এলাকায় ফ্লাই অ্যাশের ইট ব্যবহার আবশ্যক করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ দফতরের নির্দেশ ছিল, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যে কোনও নির্মাণ কাজ সারতে হবে ‘ফ্লাই অ্যাশ ব্রিক’ দিয়ে। একই নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকারও (বক্স দেখুন)।
সরকারি নিয়মের কথা মাথায় রেখে রাজ্যের বেশ কিছু শিল্পোদ্যোগী টাকা ঢেলেছিলেন ছাইয়ের ইট তৈরির কারখানায়। অভাব নেই কাঁচামালের। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছাইয়ের পরিমাণ। ১৯৯৩-৯৪ সালে বর্জ্য ছাইয়ের পরিমাণ ছিল চার কোটি টন। ২০০২-০৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি টনে। বর্তমানে এই পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। সাধারণত ছাই অ্যাশ পন্ডে ফেলা হয়। বাতাসের সংস্পর্শে এসে তা ছড়ায়। শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বাঁকুড়ার একটি ফ্লাই অ্যাশ পন্ড।—ফাইল চিত্র।
সেই ছাই ব্যবহার করে ইট তৈরি করলে দূষণের সমস্যা যেমন এড়ানো যায়, তেমনই পাওয়া যায় কিছু বাড়তি সুবিধেও। মাটির ইট জল শোষণ করে বলে তাতে ‘ড্যাম্প’ ধরার ভয় থাকে, যা ছাইয়ের ইটে থাকে না। ছাইয়ের ইটের সুষম আকারের কারণে ‘কার্পেট এরিয়া’-ও বাড়ে। প্রচলিত ইটের চাইতে ছাইয়ের ইটের দামও অন্তত ৫০ পয়সা কম। রানিগঞ্জের ছাই-ইট উৎপাদক সন্তোষকুমার তাঁতিয়ার বলেন, “হিসেব করে দেখেছি, ছাইয়ের ইট ব্যবহার করলে ২০-২২ শতাংশ বেশি লাভ হবে।” লাভ কৃষিরও। প্রচলিত পদ্ধতিতে ইট তৈরি করতে জমির উপরিভাগ থেকে মাটি কেটে নেওয়া হয়। তাতে মাটির উর্বর অংশই চলে যায় ইট তৈরিতে। বাকি মাটি চাষের অনুপযুক্ত হয়ে যায়।
দুর্গাপুরে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে তিনটি বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কয়েকটি বৃহৎ শিল্প সংস্থায় রয়েছে ক্যাপটিভ প্ল্যান্ট। একই ছবি আসানসোলেও। ফলে এই শিল্পাঞ্চল এলাকায় ছাইয়ের ইট তৈরির কাঁচামালের পর্যাপ্ত জোগান রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ন্যাশনাল স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন লিমিটেড সূত্রে জানা গিয়েছে, আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে ২৫টি ছাইয়ের ইট তৈরির কারখানা রয়েছে। সারা রাজ্যে সংখ্যাটা প্রায় ৩৫। এক একটি কারখানা গড়তে কম পক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা খরচ।
কিন্তু কারখানা মালিকদের অভিযোগ, ইট তৈরি হয়ে রোদে-জলে নষ্ট হচ্ছে। অথচ কেনার তেমন খদ্দের নেই। রানিগঞ্জে প্রায় ৮ বছরের পুরনো কারখানা রয়েছে সন্তোষকুমার তাঁতিয়ার। তিনি বলেন, “দু’একজন প্রোমোটার আবাসন গড়ার কাজে ইট কেনেন। সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য ইট কেউ কেনেন না।” কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাস্তা তৈরির কাজে তারা এই ইট ব্যবহার করে থাকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০০৩-০৪ সালে তারা ৮৮ লক্ষ ইট ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি বড় বড় নির্মাণ হলেও, তাতে ছাইয়ের ইট ব্যবহৃত হয়নি।
ছাইয়ের ইট ব্যবহারে অনীহা কেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান শুভজিৎ সরস্বতী জানান, গুণগত মান নিশ্চিত করার সব বিধি মেনে তৈরি করলে ফ্লাই অ্যাশে তৈরি ইট যথেষ্ট ভাল কাজ করে। “কিন্তু কোনও কোনও ছোট উৎপাদক বিদেশি যন্ত্র কেনার জন্য বিনিয়োগ করতে চায় না। স্থানীয় যন্ত্রে তৈরি ইট অনেক সময়েই ভাল হয় না, তাই ক্রেতার আস্থা থাকে না। তবে এখন এই ইটের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। রাজারহাটে বেশ কিছু নতুন আবাসন তৈরি হচ্ছে এই ইট দিয়ে।”
তবে ফ্লাই অ্যাশ ইট উৎপাদকদের একাংশের অভিযোগ, ঠিকাদার এবং ইট ভাটার মালিকদের দুর্নীতির জন্যই বাজার ধরতে পারছে না ছাইয়ের ইট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্গাপুরের এক রিয়েল এস্টেট সংস্থার বাস্তুকার জানান, বড় নির্মাণ কাজ অধিকাংশই করে ঠিকাদার সংস্থা। সব ছাইয়ের ইটের গুণমান এক। কিন্তু মাটির ইট বিভিন্ন গুণমানের তৈরি করা হয়। সে ক্ষেত্রে কমদামি নিম্নমানের ইট ভালো গুণমানের ইটের মধ্যে চালান করে দিয়ে বাড়তি মুনাফার সুযোগ থাকে।
ছাই ইট প্রস্তুতকারকদের সংগঠন ফ্লাই অ্যাশ ব্রিকস অ্যান্ড ব্লকস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের-এর দাবি, রাজ্য সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছেন তাঁদের সদস্যরা। কিন্তু মাটির ইট তৈরির ভাটা যত্রতত্র, বেআইনি ভাবে কাজ করছে। সরকারকে কোনও রাজস্ব দেয় না। তাই তারা শস্তাতেও ইট দিতে পারে। একমাত্র রাজ্য সরকারের কড়া নজরদারি ও সহযোগিতার মনোভাবই এই ধারা বদলাতে পারে বলে সংগঠনের দাবি।

বিধিনিষেধ
কেন্দ্রীয় ডিজাইনস অর্গানাইজেশন, ২০০২: মুখ্য বাস্তুকারদের নির্দেশ, ১০০ শতাংশ কাজে ব্যবহার করতে হবে ফ্লাই অ্যাশ ইট।
রাজ্য সরকার, ২০০৪: রাজ্যের মুখ্যসচিব অশোক গুপ্তের নির্দেশ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি সংস্থা, সরকার অধিগৃহীত সংস্থা, পুরসভা, পঞ্চায়েত প্রভৃতির নির্মাণে ফ্লাই অ্যাশ ইট কাজে লাগাতে হবে।
কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক, ২০০৭: তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১০০ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি, সব নির্মাণ করতে হবে ফ্লাই অ্যাশ ইট, টালি দিয়ে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.