স্কুল পেরোনোর পরেই গুটখার নেশা ধরেছিলেন কৃষ্ণ সুরানা। ২৮ বছরের ওই তরুণ এখন দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। তিনি চিকিৎসকদের বলেছেন, প্রতিদিন গড়ে সাত প্যাকেট গুটখা খেতেন তিনি। কয়েক মাস আগে মুখে ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁর। চিকিৎসকেরা জানান, একেবারে শেষ পর্যায়। তাঁর আয়ু আর কয়েক মাস।
কৃষ্ণ সুরানা এ রাজ্যে মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষের এক প্রতিনিধি। পরিসংখ্যান বলছে, পূর্বাঞ্চলে ক্যানসার-রোগীদের মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত। রাজ্যে সেই হার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। চিকিৎসকদের মতে, গুটখাই এই ক্যানসারের মূল কারণ। সেই জন্য অন্যান্য রাজ্যের মতো বাংলাতেও আইন করে গুটখা বিক্রি ও খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই এক চুলও।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, দেশের বেশির ভাগ রাজ্যেই গুটখা নিষিদ্ধ হয়েছে। বিধিনিষেধ জারি হয়েছে প্রকাশ্য ধূমপানেও। কিন্তু তার পর? সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহই স্বীকার করে নিয়েছেন, দেশের কোথাও তামাকজাত পদার্থের বিক্রির হার এতটুকুও কমেনি।
নিয়ম অনুযায়ী অধিকাংশ রাজ্যেই এক বছরের জন্য গুটখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরের বছর আবার ওই নিষেধাজ্ঞার পুনর্নবীকরণ হওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গে গত ১ মে গুটখা বিক্রি ও সেবন নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আইন প্রয়োগের কাজ শুরুই হয়নি। |
আইন বলবৎ করা হচ্ছে না কেন? কী বলছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা?
এ রাজ্যে গুটখা বন্ধে খোদ মুখ্যমন্ত্রী উদ্যোগী হলেও কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, তা মেনে নিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তিনি বলেন, “সমস্যাটা যে একই জায়গায় রয়েছে, তা বুঝতে পারছি। আসলে শুধু স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। পুলিশের সাহায্য দরকার। তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের পক্ষ থেকে লাগাতার প্রচারও দরকার।”
কিন্তু স্বাস্থ্য, পুলিশ ও তথ্য-সংস্কৃতি, এই তিন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব নেবে কারা?
উত্তর মেলেনি। চিকিৎসক মহলের আশঙ্কা, ঠিক যে-ভাবে প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধের আইন তৈরি করেও রাজ্য সরকার তা প্রয়োগ করতে পারেনি, সেই ভাবে গুটখা সংক্রান্ত আইনও স্রেফ সরকারি নথিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “রাস্তাঘাটে এবং মহাকরণ-সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরে অবাধে ধূমপান চলছে। কেউ আইন মানে না। এমনকী স্বাস্থ্য ভবনেও বহু কর্মীর গুটখা খাওয়ার অভ্যাস আছে।”
আইন ভেঙে গুটখা বিক্রি বা সেবন করলে কী শাস্তি হতে পারে?
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, কন্ট্রোল অফ টোব্যাকো প্রোডাক্টস অ্যাক্ট বা তামাকজাত সামগ্রী নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী আইন ভঙ্গকারীদের ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ওই সব জিনিস বিক্রি করলে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা। ছ’মাসের জেলও হতে পারে নিয়ম না-মানলে। কিন্তু এই শাস্তির ব্যবস্থা খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত এই আইনে ক’জনের শাস্তি হয়েছে, তার কোনও রেকর্ড নেই।
কী করছে পুলিশ?
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, “আইন যখন হয়েছে, ব্যবস্থা নিশ্চয় নেওয়া হবে। অভিযান শুরু হবে খুব শীঘ্রই।” মে মাসে গুটখা-বিরোধী আইন বলবৎ হয়েছে। এই সাড়ে চার মাসেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বা পুলিশ কেন অভিযানে নামেনি, সেই প্রশ্নের মুখে পুলিশকর্তারা নিরুত্তর।
আইন প্রয়োগে রাজ্য সরকারের গড়িমসিতে চিকিৎসক মহলও হতাশ। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ওই বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে পারলে কয়েক বছরের মধ্যে মুখের ক্যানসার অন্তত ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশা আছে। কিন্তু আইন রূপায়ণ করা হচ্ছে না। ধূমপানের নেশার চেয়ে গুটখার নেশা বাড়ছে। কারণ এতে খরচ কম।” ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, আইনকে ফাঁকি দিতে যে-ভাবে বহু দোকানে পানমশলা ও তামাকের আলাদা প্যাকেট বিক্রি করা হচ্ছে, সেটাও বন্ধ করা উচিত। কারণ দু’টো প্যাকেট মিশিয়ে নিলে তো সেই একই বিষ!
স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও অর্থ দফতর যাতে সমবেত ভাবে অবিলম্বে গুটখা বিক্রি ও সেবন বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়, সেই আবেদন জানিয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন গৌতমবাবুরা। |