তাহলে কি ভুলে গিয়েও আমরা অতীতের সত্তাবিলোপ না করতে পারলেও অতীতের দাঁতের ধার কমাতে পারি? ভিয়েতনামে বা হিরোশিমায় আমেরিকা যা করেছিল, নন্দীগ্রামে সিপিএম অথবা কামদুনিতে তৃণমূল যা করেছে, তা যদি বিশ্বের সমস্ত মানুষ চিরতরে ভুলেও যায়, তবু সেই দুষ্কৃতিগুলির সত্তা বিলুপ্তি হবে না। দার্শনিক সমস্যা হিসেবে সেই কারও মনে না-থাকা ঘটনাগুলির কোন বর্গে স্থান হবে— সৎ না অসৎ, আছে না নেই-এর ঘরে, তা চট করে বলা সম্ভব নয়। প্রাচীন বৈভাষিক বৌদ্ধরা অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব ঘটনা বা ধর্মের অস্তিত্ব মানতেন বলে তাঁদের সর্বাস্তিবাদী বলা হত। আচার্য বসুবন্ধুর ‘অভিধর্মকোষ’ গ্রন্থে চার জন বৈভাষিক বৌদ্ধেয় অতীত (অনাগত) ধর্মগুলির অস্তিত্ব নিয়ে চার রকমের মত ব্যাখ্যা করে সেগুলি খণ্ডন করেছেন। সে বিচার এত দুরূহ যে, প্রাতঃস্মরণীয় নৈয়ায়িক অনন্ত তর্কতীর্থ রচিত ‘বৈভাষিক দর্শন’ গ্রন্থে তার বাংলা অনুবাদ পড়েও অতীত (এমনকী ক্ষণিকবাদী মতেও) সত্তাবান, এ কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। অথচ সমস্যাটা দার্শনিকের তর্কবিলাস বলে উড়িয়ে দিতেও পারছি না। ইতিহাসের দৃষ্টিতে যাদের পূর্বপুরুষরা সমাজের দ্বারা অপাংক্তেয়, অপমানিত, বঞ্চিত হয়েছিল, সমান অধিকারের যুগেও তাদের এক অংশ গোষ্ঠীগত ক্ষতিপূরণ দাবি করে অত্যাচারী সুবিধাভোগী শ্রেণি বা জাতি বা গোষ্ঠীকে মনে করাচ্ছে ‘ভুলে যেয়ো না তোমাদের জাত আমাদের জাতকে কী শতাব্দীব্যাপী লাঞ্ছনা করেছিল, সমান হওয়ার জন্যই এখন আমাদের অসমান অধিকার চাই’, তেমনই আর এক নতুন প্রজন্ম জন্মাচ্ছে, ব্যক্তিস্বাধীনতা, আন্তর্জাতিকতা ও বহু-কৃষ্টি-মিশ্রিত স্বতন্ত্র জীবন যাপনের জন্য যারা দাবি করছে এক নতুন অধিকার: ‘ভোলার অধিকার’। |
সময়ের পথ। নন্দীগ্রাম, ২০০৭। ছবি: অশোক মজুমদার
|
আমি শুধু এক জন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নই, আমি এক জন সমকামী নর্তক, আমি মনে রাখতে চাই না যে, আমার অতিবৃদ্ধ পিতামহী কোনও নচ্ছার শ্বেতাঙ্গের ক্রীতদাস ছিলেন; আমার পুংবন্ধু টেক্সাসের এক জন শ্বেতাঙ্গ যুবক; ওই সব অতীতের জাতিগত ‘স্মৃতি’র ছাপ আমার সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বকে শৃঙ্খলিত করে রাখে। নতুন সহস্রাব্দে জেসন হিল ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি’, এই উপজাতিগত তাদাত্ম্যের রাজনীতি (আইডেন্টিটি পলিটিক্স) থেকে নিষ্কৃতির জন্য বিস্মৃতির অধিকার নিয়ে বই লেখেন, যার মূল শিরোনাম ‘বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠা: নতুন সহস্রাব্দে মানুষ হওয়ার মানে কী?’ (জেসন হিল, বিকামিং আ কসমোপলিটান, রাওম্যান অ্যান্ড লিট্লফিল্ড, ২০০০)। উল্টো দিকে, নাত্সিদের অত্যাচার যেন ভুলে না যাই বেদনা পাই, তার ব্যবস্থা করবার জন্য ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ থেকে শুরু করে ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’, ‘দ্য পিয়ানিস্ট’— কত উৎকৃষ্ট ছবিই হয়ে চলেছে।
নির্বাচনে জিতবার সময় সব থেকে নিষ্কলুষ নেতানেত্রীও কতই প্রতিশ্রুতি দেন। সব কথা তাঁরা রাখতে পারেন না। অতীতকে ভুলে গেলেই যদি তা নেই হয়ে যেত, তা হলে তাঁদের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞার বর্তমান দায়বদ্ধতার কথাই আমরা তুলতে পারতাম না। সারা দেশে অন্য কোনও একটা নতুন সন্ত্রাস (বা বিরোধী পার্টির) আতঙ্ক অথবা বিজয়োৎসব জাগিয়ে রেখে জনতাকে তাঁদের ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’গুলিকে ভুলিয়ে দিলেই কাজ মিটে যেত। অবশ্য বর্তমান জনজীবনে সাংবাদিক ও বিজ্ঞাপনদাতারা জোট বাঁধলেই আমরা কী ভুলব, কী মনে রাখব, কতখানি ‘ঘটে যা তা সব সত্য নহে’ জাতীয় উৎকট উত্তরাধুনিকতার গঞ্জিকা সেবন করে চোখের সামনে ঘটা ভ্রষ্টাচারও দেখে অ-দেখা করে রাখব, তা ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। মহাকালের মহাফেজখানায় এই অরচিত চিরবিস্মৃত ইতিহাসের ‘অকথ কহানি’ রয়েই যাবে— এ ধারণার আকর্ষণ দুর্নিবার।
আমাদের সমষ্টিচেতনায় অতীতের বিবরণ সততই পালটাচ্ছে। কিন্তু আসল অতীতকে তো সে ভাবে পাল্টানো বা কাটাছাঁটা যায় না। নথি নিশ্চিহ্ন করা যায়, স্মৃতি লোপ করা যায়, তবু বাস্তব ইতিহাসের (রচিত ইতিহাসের নয়) অঙ্গ হিসেবে অতীত থেকেই যায়। অথচ এ কথাই বা কী করে অস্বীকার করি যে, অতীতের কোনও কুখ্যাত তোলাবাজ গুন্ডা যদি বর্তমানে ভাল কাজ করে, রত্নাকর সত্যিই বাল্মীকি হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে সমাজসেবক বনে যায়, যদি ফিরিঙ্গি অ্যান্টনি কবিয়াল হয়ে মানুষের প্রেমিক হয়ে বদলে যায়, তা হলে কেবল তার দলগত, শ্রেণিগত, ধর্মগত অতীত, জাতিগত শিকড়, তার সম্প্রদায়ের কার্যকলাপের কালো চশমা দিয়ে তাকে দেখলে তো তার বাস্তবতাটাকেই বিকৃত করা হয়! যদি অতীতের গর্বান্ধ, অবিমৃশ্যভাষী, ঈর্ষালু আমি বর্তমানে অনুতপ্ত, বিনম্র, সতর্ক, সজ্জন হয়ে গিয়ে থাকি, তা হলে সেই স্বচ্ছ শোভন বর্তমান আমাকে না দেখে কেবল আমার কুৎসিত অতীতকে দিয়ে ‘তুমি তো তো এমনই লোক, তোমাকে বিশ্বাস নেই’, এ রকম ভাবলেও নিতান্ত অবিচার এবং নির্বুদ্ধিতা হবে, তাই না?
যতই আমাদের মনে বা অভ্যাসগ্রস্ত সাইন্যাপ্স-এর (দুই নিউরোন-এর মাঝখানে সংযোগ স্থাপনকারী এক স্নায়ুশাখার অন্তভাগ) সংস্কারে ছাপ রেখে যাক, অতীত অতীতই। নস্টালজিয়ার পিছুডাক অথবা বিদ্বেষের হাওয়া দিয়ে জাগিয়ে রাখা পুরনো আক্রোশের আগুন অনেক সময়ে আমাদের কাছে অতি মধুর বা অতি দুঃসহ অতীতের স্মৃতিকে বর্তমানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উজ্জ্বলতর, উৎকৃষ্টতর, ‘বাস্তবতর’ হিসেবে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু যতই স্পষ্ট স্মৃত হোক, অতীত অতীতই— এখন তার ধ্বংসাভাবই চলছে। মহানৈয়ায়িক উদয়নাচার্য তাই বেশ ঝুঁকি নিয়ে দাবি করেছেন যে স্মৃতি কখনও প্রমাণ হয় না। শুধু এ জন্য নয় যে ‘আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে’, এই অনুভবের ভিত্তিতে আমরা যে-সব ‘ভুল’ কথা গায়ের জোরে চালাই, তার সংশোধন বা সমর্থন কোনওটাই ‘পাবলিক’ উপায়ে করা সম্ভব নয়। আমার কী মনে পড়ছে, অন্যেরা কোনও দিনই জানে না, আমি নিজেও অবিকল ভাবে বলতে পারি না। ওঁর যুক্তিটা আরও জোরালো। সংস্কার অর্থাৎ পুরনো ঘটনার ছাপ-ছাড়া স্মরণের তো আর কোনও কারণ বা ভিত্তি থাকে না। ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে নকশাল-পুলিশের যুদ্ধ যদি ২০১৩ সালে কারও মনে পড়ে, তার সাক্ষাৎ কারণ ওই যুদ্ধ তো হতে পারে না; ওই যুদ্ধের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার ফলে মস্তিষ্কে বা মনে যে ছাপ রয়ে গেছে, এখন সেই সঞ্চিত ছাপটা তো সেই অভিজ্ঞতারই অনুযায়ী হবে।
স্মৃতিকে তাই হতে হবে ‘যথানুভব’— যেমন দেখেছিলাম, তেমন। যা দেখিনি, তা জুড়ে দিলে (সেটা যদি সত্যিও হয়) স্মৃতিটা অযথার্থ হবে। অথচ যখনই আমরা ৪৩ বছর পরে স্মরণ করছি, তখনই ‘দেখছি পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে’-এর সঙ্গে যোগ করি ‘দেখেছিলাম ৪৩ বছর আগে...’। এই যোজনাটা তো পূর্বানুভব আর তার সংস্কার থেকে আসছে না। এই যোজনা ছাড়া ‘ওই তো পুলিশ অত্যাচার করছে’ বললে সেটাও অযথার্থ হবে (২০১৩’য় তো পুলিশ প্রেসিডেন্সিতে নকশালদের ওপর অত্যাচার করছে না) আর, ‘৪৩ বছর আগে করেছিল’ যোগ করলেও সেটা যথা-অনুভব-তথা হচ্ছে না। অতএব স্মৃতি যথার্থই বা হয় কী করে?— বলেছেন উদয়নাচার্য। অতীতকে আমরা শ্রদ্ধা করতে পারি, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে পারি, স্মৃতির ওপর নির্ভর না করে আমাদের অনুমান, প্রত্যক্ষ, শব্দপ্রমাণ— কোনও কিছুই সম্ভব হয় না। কিন্তু স্মৃতি নিজে একা একা একটা প্রমাণ নয়— এটাই ন্যায়দর্শনের সিদ্ধান্ত। অতীতকে ভুলে গিয়ে বিলুপ্ত করা যায় না, ফিরিয়েও আনা যায় না, অতীতকে প্রত্যক্ষ প্রমাণে পাই না কিছুতেই। এই বিষয়ে এ যুগের প্রমুখ ইতিহাস-দার্শনিক পল রিক্যোর স্মৃতি ও বিস্মৃতি নামে একটি সুন্দর বই লিখেছেন, সম্প্রতি তা ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। স্মরণে জেগে থাকা অতীতের বিষয়ে দার্শনিক সমস্যাটিকে রিক্যোর খুব ঝরঝরে ভাষায় তিনটি বৈশিষ্ট্যে পর্যবসিত করেছেন: থাকা, না-থাকা ও দূরত্ব। আমাদের ফেলে আসা দিনগুলি বিষয়ে তিন রকম ‘অবভাস’ই হয়: এখন আর নেই/হচ্ছে না; অথচ এখনও বাস্তব— কোথায় যেন রয়ে গেছে; আর দিন দিন পিছনে দূরে চলে যাচ্ছে। সেই ছ’বছর আগে নন্দীগ্রামে, ওই সেই সময়ে যখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী আত্মহত্যা করলেন— এই সব ঘটনা ও তার কালগুলিকে বর্তমানের মর্যাদা না দিলেও, অপরিবর্তনীয় বাস্তবের মণিকোঠায় না রেখে উপায় নেই। কেবল যা কারও মনে নেই, কোথাও কারও বর্ণনা বা আখ্যানেও যার চিহ্নলেশ নেই, সেই সব চির-অজানা অতীতকে নিয়েই মুশকিল। তারাও আছে, তারাও অস্তিত্ববান— এই দাবির নগদমূল্যটা ঠিক কী, আমরা আজও জানি না।
অতীতের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব এবং তাকে ভোলা অথবা না-ভোলার দায়িত্ব বা অধিকারের ব্যাপারটা আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাত্যহিক ভাবাবেগ ঝগড়া-মিটমাটের সঙ্গেও এত মাখামাখি হয়ে জড়িয়ে আছে যে, ব্যাপারটা জটিল বলেই ওটা নিয়ে না ভাবাটা কাজের কথা নয়। কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে। আমাদের সুবিধে মতো আমরা বন্ধুকে কখনও বলি ‘তবু মনে রেখো’, কখনও বা বলি ‘ভুলে যাও’। কিন্তু কারও জীবনই অতীতকে বাদ দিয়ে হয়নি, তা সে যতই সম্প্রতিসর্বস্ব নবীন যুবা বা কুল-গোষ্ঠী-স্বদেশ-চিহ্ন লোপকারিণী আগামী কালের বাসিন্দা ব্যক্তি-নারী হোন না কেন।
স্মৃতি ও ভবিষ্যৎ, দুইয়ের মধ্যে স্যান্ডউইচের পুরের মতো চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে আছে আমাদের বর্তমান কাল। অর্ধবিস্মৃত ঝলসানো অতীতের আর অনাগতের সবুজকাঁচা আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে কামড় না বসিয়ে শুধুমাত্র মাঝখানের ইদানীংটুকুর স্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকা কেবল ধ্যানসিদ্ধ মুক্তপুরুষ বা হিপোক্যাম্পাস ক্ষয়ে আসা অপস্মার রোগী ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আগামী কাল আমরা কেমন সমাজ গড়ব, তার নির্দেশ পেতে গেলে গত কালের কাছে আমাদের অনেক প্রশ্ন নিয়ে যেতেই হবে। বলতেই হবে ‘হে অতীত কথা কও।’
পিতৃপক্ষের শেষে মহালয়ার দিন গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করতে গিয়ে তাই আমরা অতীতের উদ্দেশে অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে মন্ত্র বলি: ‘যারা অতীতের বান্ধব, অবান্ধব, অনাত্মীয়, যারা অন্য পূর্ব পূর্ব জন্মে বান্ধব ছিল, তারা সবাই আমার দেওয়া এই জলের দ্বারা তৃপ্ত হোক।’ বিস্মৃত অতীত জানা-অজানা নিযুত-কোটি মানুষের ধারার ধার না ধারলে উগ্র-প্রগতিশীল আমাদেরও বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। |