দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ধ্বংসাবশেষের চিত্র ইতিমধ্যে সুপরিচিত। চিত্রটি ভয়ঙ্কর। জানালার গরাদ, স্কুলের চেয়ার টেবিল আলমারি ইত্যাদির ক্ষয়ক্ষতি যত ভয়ঙ্কর, তাহা অপেক্ষা বহুগুণ ভয়ঙ্কর অন্য এক বিনাশ, যাহার স্বরূপ ওই চিত্রে প্রকাশ্য নয়, নিহিত হইয়া আছে। সেই ক্ষয়ক্ষতি প্রশাসনের। পুলিশ প্রশাসনের চোখের আড়ালে অনেক তাণ্ডব ঘটিয়াই থাকে। কিন্তু বিবিধ থানার দারোগা এবং তাহারও উচ্চতর স্তরের পুলিশ অফিসারের উপস্থিতিতে সে দিন যাহা ঘটিয়াছে, তাহার পরে প্রশাসন শব্দটিই নিরর্থক হইয়া পড়ে। বিশৃঙ্খলা নিবারণের বা দমনের কোনও চেষ্টা না করিয়া জনতার দাবির নিকট আত্মসমর্পণের এই কাহিনি, পশ্চিমবঙ্গের মাপকাঠিতেও, চমকপ্রদ। নিষ্ক্রিয়তার যুক্তি হিসাবে পুলিশ জানাইয়াছে, সক্রিয় হইবার জন্য ‘উপরতলার নির্দেশ ছিল না’। কোনও কোনও উত্তর প্রশ্ন অপেক্ষাও রহস্যময়। একটি সামান্য অশান্তি, যাহা শুরুতেই নিবারণ করা যাইত, তাহার মোকাবিলার জন্য কোন উপরতলা হইতে নির্দেশ আনাইবার প্রয়োজন হয়? মনে হইতেই পারে, সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্তা ও কর্মীরা আপন অপদার্থতার সাফাই দিবার উদ্দেশ্যেই উপরতলার কথা পাড়িয়াছেন। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা হইবে নিতান্ত অতিসরল। স্পষ্টতই, স্থানীয় একটি গোলযোগ থামাইবার জন্য যে পদক্ষেপগুলি করা দরকার ছিল, উপস্থিত পুলিশ অফিসাররা তাহাও নিজ দায়িত্বে করিবার সাহস পান নাই। তাহার সহিত যদি অপদার্থতা যুক্ত হইয়া থাকে, তাহাও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নহে। আত্মপ্রত্যয়ের অভাব এবং দক্ষতার অভাব, পুলিশের দুইটি ব্যাধি একই উৎস হইতে সঞ্জাত।
উৎসটি প্রাচীন। বামফ্রন্ট আমলের। সেই জমানার নায়করা প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয় নিয়ন্ত্রণ জারি করিয়াছিলেন। পুলিশ প্রশাসনের পরিচালকরা নির্ধারিত নিয়ম ও আচরণবিধি মানিয়া আপন কর্তব্য পালন করিবেন, সেই স্বাধীনতা তাঁহাদের ছিল না, যে কোনও সিদ্ধান্তের জন্য তাঁহাদের ঊর্ধ্বমুখে বসিয়া থাকিতে হইত। প্রায়শ উচিত সিদ্ধান্ত লইবার পরে উপরতলার নির্দেশে তাহা প্রত্যাহার করিতে বা এমনকী উল্টাইয়া দিতে হইত। দীর্ঘ কাল ধরিয়া এই ব্যবস্থা চলিবার ফলে পুলিশ প্রশাসনের মেরুদণ্ডই কেবল অশক্ত হইয়া পড়ে নাই, তাহার তৎপরতা ও বিচারবুদ্ধিরও ক্ষয় হইয়াছে। তাহা অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিণাম। উপরমহলের ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্থ থাকিতে হইলে কর্মদক্ষতা বজায় থাকে না। শেষ পর্যন্ত তাহার মাসুল গনিতে হইয়াছে বামফ্রন্টের নায়কদেরই। নন্দীগ্রামের কাহিনিতে পুলিশ প্রশাসনের কোন অপদার্থতার কাহিনি লিখিত আছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাহা বিলক্ষণ জানেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় সর্বগ্রাসী দলতন্ত্র পূর্ববর্তী আমলের সমান প্রবল ও সক্রিয়, এমন কথা বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। সর্বগ্রাসের আকাঙ্ক্ষা সমান হউক বা না হউক, সব কিছু দখল করিবার বিষয়ে বামফ্রন্টের তুল্য সামর্থ্য বর্তমান শাসক দলের নাই। কিন্তু ব্যাধি যে দূর হয় নাই, দমদমের ঘটনাতেই তাহা স্পষ্ট। পুলিশ এক দিকে ঠায় দাঁড়াইয়া ভাঙচুর দেখিতেছে, অন্য দিকে ঘটনার পাঁচ দিন পরে তদন্তের প্রাথমিক কাজ শুরু করিতেছে— ইহার পিছনে কাহারও কোনও অঙ্গুলিনির্দেশ কাজ করিতেছে না, এমন কথা ভাবা কঠিন। মুখ্যমন্ত্রী যদি সত্যই পরিবর্তন চাহেন, তবে পুলিশ প্রশাসনকে সুস্পষ্ট ভাবে জানাইয়া দিন যে, তাহারা নির্দিষ্ট বিধি মানিয়া সৎ ভাবে কাজ করিলে কোনও অবস্থায় উপরমহল হইতে অন্যায় হস্তক্ষেপ করা হইবে না। এই নিশ্চয়তা থাকিলে এক দিকে প্রশাসনের পক্ষে যথাযথ ভাবে আপন কর্তব্য পালন সম্ভবপর হইবে; অন্য দিকে, গাফিলতি বা দুর্নীতির দ্রুত ও যথোচিত প্রতিবিধানও সহজ হইবে। এক কালে পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়মবদ্ধ প্রশাসনের প্রচল ছিল। সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব নহে। কেবল তাহার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা আবশ্যক। |