ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে ফের এক রোগিনীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। বুধবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মৃতের নাম সাধনা শাহ (৩৭)। বাড়ি বাগডোগরা সুভাষপল্লি। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁর মৃত্যু হয়েছে এনসেফেলাইটিসে। জ্বরে অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে দিন পাঁচেক আগে বাগডোগরা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাইরে থেকে এনএস-১ পরীক্ষায় তাঁর রক্তের ডেঙ্গির জীবানু থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সোমবার তাঁকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গি ওয়ার্ডে ভর্তি কারনো হয়। মঙ্গলবার গভীর রাতে তাঁকে মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছিল। এ দিন ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়। হাসপাতালের সুপার সব্যসাচী দাস বলেন, “ওই মহিলা ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে চিকিৎসায় তা থেকে সুস্থ হন। পরে তাঁর বুকে সংক্রমণ হয়। তা ছাড়াও পরে এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন থাকায় তাকে মেডিসিন ওয়ার্ডে নেওয়া হয়।”
বাড়ির লোকের নালিশ, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলেও তাঁর সঠিক চিকিৎসা হয়নি। তাই সাধনাদেবীকে মরতে হল। মৃতার দেওর সন্তোষ শাহ বলেছেন, “বাগডোগরা হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় বাইরে থেকে রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গির জাবীণু পাওয়া যায়। এর পরই সেখান থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে সঠিক চিকিৎসা মেলেনি। তা ছাড়া ডেঙ্গি ওয়ার্ড থেকে রাতে মেডিসিন ওয়ার্ডে কখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাও আমরা জানতাম না।”
|
ডেঙ্গিতে মারা যাওয়ার বিষয়টি ধামা চাপা দিতেই তা করা হয়েছি কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন পরিবারের লোকেরা। তা ছাড়া এনসেফ্যালাইটিস রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষাও হয়নি। কিসের ভিত্তিতে এনসেফ্যালাইটিসে মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে তা নিয়েও সন্দেহ মৃতার পরিচিতেদেরও। অভিযোগ, রোগিনীকে রক্ত বা অনুচক্রিকা দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করাও হয়নি। সিপিএম কাউন্সিলার জয় চক্রবর্তী অসুস্থ। চিকিৎসকদের অনুমান তিনিও ডেঙ্গিতে আক্রান্ত।
২৯ অগস্ট শিলিগুড়ির ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের লিম্বু বস্তির বাসিন্দা কিশোরী রশ্মি মাঝির মৃত্যু হয়। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে নার্সিংহোমে পাঠানো হয়েছিল বলে অভিযোগ তুলেছিলেন বাড়ির লোক। পরে সাদ্দাম হোসেন নামে গাঁধীনগরের বাসিন্দা ১৬ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু হয় ডেঙ্গিতে। রেখা সাহানি নামে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জ্বরে আক্রান্ত আরও এক কিশোরীর মৃত্যু হলেও ডেঙ্গি নির্ণয়ে তাঁর কোনও রক্ত পরীক্ষা হয়নি। দু’ দিন আগেই ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি সুরঞ্জন চক্রবর্তী নামে এক প্রবীণ ব্যক্তির মৃত্যু হয় তিলক রোডের একটি নার্সিংহোমে। তবে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন ডেঙ্গি থেকে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। পরে ইন্টারস্টিশিয়াল লাংস ডিজিস (আইএলডি)-এ তিনি মারা যান। এর পরে এ দিন বাগডোগরার বাসিন্দা ওই মহিলা মারা যান। মঙ্গলবার কোচবিহার এমজেএন হাসপাতালে ডেঙ্গি আক্রান্ত পূর্ণ দাস নামে ৫৩ বছরের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তাঁর বাড়ি কোচবিহার ২ ব্লকের ধর্মঘরকুঠি এলাকায়।
শিলিগুড়ি এবং আশপাশে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর শহরের বিভিন্ন নার্সিংহোম এবং শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতাল থেকে রোগীদের ডেঙ্গি সন্দেহে ১৩৪ জনের রক্ত পরীক্ষার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তার মধ্যে ১২৪ জনের রক্তের ডেঙ্গির জাবীণু মিলেছে। তাঁর মধ্যে অন্তত ৫০ জন শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি। বাকিরা শহরের বিভিন্ন নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছেন। তাতে এখন পর্যন্ত শিলিগুড়ি পুর এলাকা, মহকুমার অন্যান্য অংশ এবং লাগোয়া জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ ব্লকের অংশে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৭০০ ছুঁই ছুঁই। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অন্তত ৮০ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছেন। |
জ্বরে আক্রান্ত বাম কাউন্সিলরকে দেখতে হাসপাতালে মেয়র।—নিজস্ব চিত্র। |
শহরের নার্সিংহোমগুলিতে ভর্তি ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা দেড়শোর বেশি। প্রতিদিনই জ্বর নিয়ে চিকিৎসা করাতে গড়ে ১০০ জন রোগী আসছেন শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে। তাদের অনেকের রক্তে ডেঙ্গি জীবাণু থাকলেও হাসপাতালে ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবারের লোকেরা। দার্জিলিং জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবীর ভৌমিক এ দিন বলেন, “জ্বর হলেই অনেকে ভয় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইছেন। তাদের ভর্তি করতে হলে হাসপাতালে অন্য রোগীদের জায়গা করে দেওয়া যাবে না। তবে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত যাঁরা, তাঁদের হাসপাতালে রেখেই চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন রয়েছে তেমন কাউকে যাতে ফিরিয়ে দেওয়া না হয় তা দেখতেই মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলার সঙ্গে তাদের চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে তাই নানা অভিযোগ উঠছে। ডেঙ্গি আক্রান্ত জানার পর বাড়ি রেখে চিকিৎসা করাতেও অনেকে সাহস পাচ্ছেন না। হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিলে তাই তারা নার্সিংহোমে যাচ্ছেন। বেসরকারি নার্সিংহোমগুলির সঙ্গে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মীদের একাংশের যোগসাজশেই রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন রোগীর পরিবারের একাংশ। এ ছাড়া, বাগডোগরার মতো হাসপাতালে ডেঙ্গি নির্ণয়ক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা এই না থাকায় বেসরকারি ল্যাবে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। সেখানে প্রায় ৩ গুণ খরচ বেশি দিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হচ্ছে বলে রোগীর পরিবারের অভিযোগ। রাজ্যের স্বাস্থ্য বিষক কমিটির চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য কমিটির বৈঠকে তিনি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন। হাসপাতালে ডেঙ্গি রোগীদের শয্যা বাড়ানোর বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
|