সেলুলয়েডের কাহিনি উঠে এসেছে জলপাইগুড়ির শিরিষতলায়!
সঞ্চিতার রক্তে ক্যানসার হয়েছে। স্টেজ ফোর। তাঁর বাঁচার আশা ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। দীপু রজককে তবু দমানো যায়নি। তাঁদের ৬ বছরের প্রেমকে মর্যাদা দিতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে থাকা প্রেমিকাকেই বিয়ে করেছেন ওই তরুণ। তার পর বলেছেন, “দেখে নেবেন কার জোর বেশি, মৃত্যু না প্রেমের!”
সঞ্চিতার তখন ক্লাস টেন, দীপুর এগারো। বছর ছ’য়েক আগে সেই সময় স্থানীয় এক কোচিং সেন্টারে দু’জনের পরিচয়। তার পর প্রেম। অভিভাবকেরা সব জানতেন। সঞ্চিতা বলছিলেন, “মাধ্যমিক পাশ করে আনন্দচন্দ্র কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই আমার ক্যানসার ধরা পড়ল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য দীপুই কলকাতায় নিয়ে আসত। শরীরটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। এরই মধ্যে এক দিন ও বলল, বিয়ে করব। আমি রাজি হইনি। ও জেদ ধরল। তা-ও বললাম, না। ও তখন আত্মহত্যা করতে গেল।” তার পর আর ‘না’ বলতে পারেননি সঞ্চিতা। গত ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়।
সঞ্চিতা-দীপুর ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে গল্প-উপন্যাস-সিনেমায়। যেমন, যতীন-কুড়ানি। রবীন্দ্রনাথের ‘মাল্যদান’ গল্পে মৃত্যুশয্যায় থাকা কুড়ানি যতীনের হাত থেকে বরমাল্য গ্রহণ করে আনন্দে, পূর্ণতায় কেঁদে ফেলেছিল। সত্তরের দশকে ঋ
ষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘মিলি’-তে ‘পার্নিসিয়াস অ্যানিমিয়া’ আক্রান্ত প্রেমিকাকে রোগশয্যায় বিয়ে করেছিলেন নায়ক। তার পর স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে উড়ে গিয়েছিলেন সুইৎজারল্যান্ড। |
কয়েক বছর আগে মণিরত্নমের ‘গুরু’ ছবিতে ‘মাল্টিপল স্কেলরোসিস’ নামে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত মিনুকে সব কিছু জেনে বিয়ে করেছিলেন সাংবাদিক শ্যাম। সিনেমায় যা ঘটে, বাস্তবেও তা করে দেখিয়েছেন জেফ ল্যাং! আমেরিকান কন্যা জেন বুলিক স্টেজ ফোর ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, জেনের আয়ু বড়জোর মাস ছ’য়েক। তাতে প্রেমের বাঁধন আলগা হয়নি। গত ২৭ জুলাই মৃত্যু পথযাত্রী প্রেমিকাকে বিয়ে করেছেন জেফ।
কলকাতার ক্যানসার চিকিৎসক অনুপ মজুমদার বলছিলেন, বছর চোদ্দো আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার একটি মেয়ের গ্ল্যান্ডের ক্যানসার হয়েছিল। ধরা পড়েছিল শেষ পর্যায়ে। তাঁর প্রেমিক মেয়েটির সঙ্গেই গবেষণা করতেন। রোগ ধরা পড়ার পরে তাঁদের বিয়ে হয়। চিকিৎসকেরাও নিমন্ত্রিত ছিলেন সেখানে। মেয়েটি বছর দু’য়েক পর মারা যান। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর চিকিৎসক জীবনে এই রকম একটি ঘটনা দেখেছিলেন ১৯৮৬-৮৭ সালে। সেখানেও স্তনের ক্যানসারে আক্রান্ত প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলেন প্রেমিক। আবার ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অর্ণব গুপ্তর মনে পড়েছে প্রায় ২১ বছর আগের একটি ঘটনা। পায়ুদ্বার থেকে ফুসফুসে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছিল এক যুবকের। তিনি হাসপাতালে যে শয্যায় ছিলেন, ঠিক তার পাশের শয্যাতেই এক প্রবীণ ভর্তি ছিলেন। তাঁর মেয়ে বাবাকে দেখতে আসতেন। তাঁর সঙ্গেই প্রেম হয় ক্যানসার-আক্রান্ত যুবকের, যা পরিণতি পায় বিয়েতে। যুবকটি অবশ্য বেশি দিন বাঁচেননি।
কলকাতায় হাসপাতালে বসে সঞ্চিতা-দীপু শোনাচ্ছিলেন ওঁদের কথা। দু’জনেরই রোগাপাতলা চেহারা। কথা বলার সময় একে-অন্যের দিকে সলজ্জ তাকাচ্ছিলেন। ছ’মাস হল বিয়ে হয়েছে। সবটা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না সঞ্চিতার! এর মধ্যেই তাঁর ওষুধের ‘ডোজ’ বেড়ে গিয়েছে। শরীর আরও দুর্বল হয়েছে। মৃত্যুভয় যেন হাতছানি দিচ্ছে তরুণীকে। দীপু অবশ্য এ সব নিয়ে ভাবতেই নারাজ। “ডাক্তারবাবু বলেছেন, ভরসা না-হারাতে। সব ঠিক হয়ে যাবে। জানেন, আমাদের বাড়িতে সঞ্চিতার অসুখ নিয়ে কেউ আলোচনা করে না। মাঝে-মধ্যে মা শুধু আমাকে বলেন, ওর ওষুধ খাওয়ার দিকে নজর রাখিস। আমি ওকে মরতে দেব না, দেখবেন!” স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে যান বছর চব্বিশের দীপু।
চিকিৎসা-পরিভাষায় সঞ্চিতার ‘ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া’ হয়েছে। রক্তে শ্বেতকণিকার ক্যানসার। চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “২০০১ সালের পরে এই রোগের ভাল ওষুধ বেরিয়েছে। কিন্তু ৯০% ক্ষেত্রে রোগ এত শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে যে প্রায় কিছুই করার থাকে না। সঞ্চিতার ক্যানসার-ও ধরা গিয়েছে স্টেজ ফোরে। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করছি। বাকিটা ভবিতব্য।”
জলপাইগুড়ির দীপু অবশ্য স্ত্রীর জীবন ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে না দিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে চান। পণ করেছেন, কোনও মতেই হারতে দেবেন না সঞ্চিতাকে। ওঁদের মনের জোর দেখে হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও এখন অন্য রকম বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।
দেখা যাক কার জোর বেশি। মৃত্যুর না প্রেমের! |