|
|
|
|
তেরোর জায়গায় তেইশ, খেসারত নিত্যযাত্রীরই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আমনাগরিকের খরচ বাঁচাতে চাইছে সরকার। বাসভাড়া তাই বাড়ছে না। কিন্তু নীতিরক্ষার সেই সরকারি তাগিদের খেসারত বাস্তবে সাধারণ মানুষই দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে নিত্যযাত্রী মহলে। তাঁরা দেখছেন, ভাড়া বাড়লে বাড়তি যত গুনতে হতো, এখন পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার অনেকটা বেশি। কিছু ক্ষেত্রে যাতায়াতে একপিঠেই লেগে যাচ্ছে অতিরিক্ত প্রায় দশ টাকা!
তবু ওঁদের উপায় নেই। কারণ, রাস্তায় বেসরকারি বাস বিরল থেকে ক্রমশ বিরলতর। অগত্যা বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে। অটো-মেট্রো-রিকশা ইত্যাদি বিবিধ পরিবহণ-মাধ্যম ব্যবহার করে, যাত্রাপথ ভেঙে ভেঙে পৌঁছতে হচ্ছে গন্তব্যে। স্বভাবতই খরচ বাড়ছে।
যেমন বেড়েছে হরিনাভির সুরথ মিত্রের। দক্ষিণ শহরতলির রাজপুর থেকে সপ্তাহে পাঁচ দিন ধর্মতলা অফিস করতে আসেন। বিশ কিলোমিটার যেতে এখন বাসভাড়া দেন ৮ টাকা, যা বাড়িয়ে ১৫ টাকা করার দাবি জানাচ্ছেন মালিকেরা। সরকার মানতে না-চাওয়ায় বছরখানেক ধরে রুটে বাসের সংখ্যা কমছে। সুরথবাবুকে যার মাসুল গুনতে হচ্ছে। সময়মতো বাস পাচ্ছেন না, পেলেও ভিড়ের চোটে পা গলায় কার সাধ্যি! বাধ্য হয়ে সপ্তাহে গড়ে অন্তত তিন দিন অফিসযাত্রার ‘বিকল্প পথ’ ধরতে হচ্ছে।
বিকল্প, অর্থাৎ রাজপুর থেকে অটো চেপে গড়িয়া। তার পরে মেট্রো ধরে ধর্মতলা। একপিঠেই পড়ে যাচ্ছে ১৯ টাকা! উপরি পাওনা অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে নাস্তানাবুদ হওয়া আর দৌড়ে-ঝাঁপিয়ে মেট্রো ধরার ধকল। “এত হ্যাঙ্গাম পোষায়? খরচের কথা না হয় বাদই দিলাম!”— আক্ষেপ করছেন মধ্যবয়সী ওই সরকারি কর্মী। |
|
ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটে নামার আগে থেকেই শহরের পথে বেসরকারি
বাস কার্যত উধাও। তাই অটো ধরার মরিয়া চেষ্টা। — নিজস্ব চিত্র। |
এ দিকে ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার ও কাল শুক্রবার মালিকেরা যে দু’দিনের বাস ধর্মঘট ডেকেছেন, তার প্রস্তুতি হিসেবে মঙ্গলবার থেকেই বিভিন্ন রুটে বাস আরও কমতে শুরু করেছে। ফলে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন সুরথবাবু। তাঁর আশঙ্কা, এ সপ্তাহের বাকিটা তো বটেই, ভাড়া-বিতর্ক চলতে থাকলে পথের ভোগান্তি সারা বছরের সঙ্গী হয়ে না-দাঁড়ায়। উনি বিলক্ষণ জানেন, বাস-মালিকেরা কেন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। জানেন, গত চার বছরে কী ভাবে ডিজেলের দর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, বেড়েছে নানা ধরনের কর ও যন্ত্রাংশের দাম। এ-ও জানেন, ভাড়া না-বাড়লে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই রাস্তা থেকে বেসরকারি বাস বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য। “এর চেয়ে ভাড়া বাড়লেই তো বরং ভাল ছিল! অন্তত বাস মিলত, একটু শান্তিতে যাতায়াত করতে পারতাম। এখন ঝক্কির শেষ নেই, খরচও পড়ছে বেশি।”— বলছেন তিনি।
বস্তুত সুরথবাবু হিসেব কষে দেখেছেন, মালিকদের দাবিমতো ভাড়া বেড়ে ১৫ টাকা হলেও তাঁর ৪ টাকা সাশ্রয় হতো। যাতায়াত মিলিয়ে রোজ বাঁচত ৮ টাকা। সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিস, মানে পথ-ব্যয় কমত সপ্তাহে ৪০ টাকা। অর্থাৎ, বাসভাড়া বাড়লে তাঁর বেশি তো লাগতই না, উল্টে মাসে অন্তত দেড়শো টাকা কম খরচ হতো!
হরিনাভির সুরথ মিত্রের মতোই ভুক্তভোগী হরিদেবপুরের সায়ক দত্ত। বাসের অভাবে বুধবার যাঁকে টালিগঞ্জে এসে মেট্রো ধরতে হয়েছে। এবং অটো না-পেয়ে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছতে যিনি রিকশাভাড়াই গুনেছেন ৩০ টাকা! শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাঁরা অফিসপাড়ায় রোজ অফিস করতে আসেন, তাঁদেরও অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য মোটামুটি এক। অধিকাংশই বলছেন, ভাড়া না-বাড়ানোয় সুবিধার বদলে অসুবিধে হচ্ছে বেশি। তাই ওঁরা জানতে চান, বাস কমতে থাকায় যে চাপ নিত্যদিন নিত্যযাত্রীদের উপরে পড়ছে, তার সুরাহা সরকার কী ভাবে করবে?এ দিন মহাকরণে প্রশ্নটির মুখে পড়ে কার্যত জবাব খুঁজে পাচ্ছিলেন না রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। একটু সময় নিয়ে পুরো দায়টা তিনি অটোর উপরে চাপিয়ে দিলেন। মন্ত্রী বললেন, “অটোর চরিত্রটাই বদলে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। যে যেমন খুশি ভাড়া নিয়েছে। রুট ঠিক করেছে। আমরা আস্তে আস্তে সব ঠিক করব। মিটার চালু করব। মানুষের সমস্যা হবে না।” যদিও পরিবহণ দফতরের দায়িত্ব নিয়ে মদনবাবু অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে যে টাস্ক ফোর্স গড়েছিলেন, তার সুপারিশ এখনও জমা পড়েনি। উপরন্তু অটো-রাজে রাশ দিলেও তিন চাকার যানটিকে বাসের ‘বিকল্প’ হিসেবে দেখার বাস্তবতা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন পরিবহণ-কর্তাদের অনেকে। তাঁরাও বুঝে উঠতে পারছেন না, চোখের সামনে সব কিছু মহার্ঘ হওয়া সত্ত্বেও বাসভাড়া বাড়াতে রাজ্য সরকারের আপত্তিটা কোথায়। |
|
বিরল দৃশ্য। বাসশূন্য ধর্মতলার রাস্তা। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক। |
রাজ্য অবশ্য অনড়। ধর্মঘট করলে বাসের পারমিট বাতিলের হুমকিও দিয়েছেন মদনবাবু। এমনকী, প্রয়োজনে বেসরকারি বাস হুকুমদখল করে চালানোর কথাও জানিয়েছেন। এ দিন বিকেলে খড়্গপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “কী কী ব্যবস্থা নেব, এখনই বলছি না। তবে যাঁরা ধর্মঘট ডেকেছেন, তাঁদের জামাই আদর করব না।”
মন্ত্রীর এ বক্তব্যেও অবশ্য ভোগান্তির আশঙ্কা কমছে না। বাস ও মিনিবাস-মালিকদের অধিকাংশ সংগঠন ধর্মঘটে অবিচল। তাদের দাবি, এই দু’দিন কলকাতা ও লাগোয়া জেলাগুলোয় প্রায় চার হাজার বাস ও সতেরোশো মিনিবাসের চাকা গড়াবে না। জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটসের যুগ্ম সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “বেসরকারি কোনও বাস এই দু’দিন বেরোবে না। এই মুহূর্তে সরকার পর্যাপ্ত ভাড়া না-বাড়ালে যাত্রীদের পাশাপাশি পরিবহণকর্মীরাও সঙ্কটে পড়বেন।” সরকারের ‘খামখেয়ালি মনোভাবের’ সমালোচনা করেছেন সিটু-সমর্থিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল রোড ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের’ সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। দুর্ভোগ বাড়াতে লাক্সারি ট্যাক্সিও আজ এক দিনের ধর্মঘট ডেকেছে।
দু’দিনের ‘প্রতীকী’ ধর্মঘটেও যদি সরকারের মনোভাব না বদলায়?
মালিকেরা জানাচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে পুজোর পরে রাস্তায় বাস নামানোই যাবে না। পরিবহণ দফতরের তথ্যও বলছে, ২০০৯ থেকে ধরলে এ পর্যন্ত ডিজেলের দাম বেড়েছে বাইশ বার, ৩৫ টাকা ৩ পয়সা থেকে দাঁড়িয়েছে ৫৬ টাকা ৩৩ পয়সায়। এই ক’বছরে বাসের ভাড়া বেড়েছে ১ টাকা! এ অবস্থায় বাড়তি আয় ছাড়া বাস চালিয়ে লোকসান করতে মালিকেরা নারাজ। |
বিস্তারিত... |
তাতেও অবশ্য পরিবহণমন্ত্রী বিচলিত নন। “ওঁরা চার দিনের বন্ধ চোদ্দো দিন করতে পারেন। ভাড়া বাড়বে না।”— এ দিন সাফ জানিয়েছেন মদনবাবু। ধর্মঘটী বাস-মালিকেরা সিপিএমের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছেন বলেও তাঁর দাবি। যা শুনে ধর্মঘটী বাস ও মিনিবাস সংগঠনের নেতাদের প্রতিক্রিয়া, “এর মধ্যে রাজনীতি নেই। সম্পূর্ণ বাঁচার তাগিদেই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।” অন্য দিকে মহাকরণের বক্তব্য, এই সরকার বন্ধ-হরতাল-ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। প্রশাসনের মতে, বাস ধর্মঘটের ডাক পুজোর মুখে জনসাধারণকে দুর্ভোগে ফেলার কৌশল। এবং এমন যে কোনও কার্যকলাপ সরকার কড়া হাতে রুখতে বদ্ধপরিকর। কী ভাবে?
পূর্বতন সরকারকে কটাক্ষ করে মদনবাবু বলেন, “আমি তো জলকামান বা অস্ত্র নিয়ে ধর্মঘট রুখতে যাব না। পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া ছ’শো ভাঙাচোরা বাস আর বাইশ হাজার কর্মী নিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করব।” মন্ত্রী জানান, বিভিন্ন পরিবহণ নিগমকে বলা হয়েছে সরকারি বাসের পাশাপাশি বাইরে থেকে বাস নিয়েও চালাতে।
তাতে কতটা লাভ হবে, সে ব্যাপারে পরিবহণ-কর্তাদের অনেকে সন্দিহান। কারণ, এর জন্য অর্থ দরকার। আর নিগমগুলোর ভাঁড়ে যে মা ভবানী, সেটা তাঁদের চেয়ে ভাল আর কে জানে!
|
পুরনো খবর: ধর্মঘটের দু’দিন আগেই বাস নেই, ভোগান্তি |
|
|
|
|
|