পোলিয়ো নির্মূল করিবার কাজে অনেকটাই সাফল্য মিলিয়াছে। এ বার হাম (মিজল্স) নির্মূল করিবার উদ্যোগ। নয়াদিল্লিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি বৈঠকে ভারত-সহ এশিয়ার ১১টি দেশ অঙ্গীকার করিয়াছে, ২০২০ সালের মধ্যে হাম এবং রুবেলা, শিশুঘাতী এই দুইটি রোগ নিশ্চিহ্ন করা হইবে। সরকারি হিসাবেই ভারতে প্রতি বছর অন্তত ৪০ হাজার শিশু হামের সংক্রমণের জন্য মারা যায়, বাস্তবে সংখ্যাটা অনেক বেশি বলিয়াই মনে করিতেছেন বিশেষজ্ঞরা। পোলিয়োতে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ব হইতে মুক্তি মিলিয়াছে অগণিত শিশুর। তাহা সম্ভব করিয়াছে প্রতিটি শিশুর নজরদারি এবং পুনঃপুনঃ টিকাকরণের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত একটি বিশাল, প্রশিক্ষিত ও তৎপর কর্মিবাহিনী। সেই বাহিনীকে ব্যবহার করিয়া, তাহাদের পদ্ধতি কাজে লাগাইয়া, হাম হইতেও মুক্তি মেলা সম্ভব। কেবল বর্তমান প্রজন্ম নহে, আগামী প্রজন্মের শিশুরাও এই রোগ হইতে মুক্তি পাইবে। একই সঙ্গে সকল মানবশিশুর টিকাকরণ করিলে কোনও শরীরেই রোগের জীবাণু আশ্রয় পাইবে না। এক নাগাড়ে দীর্ঘ দিন নিরাশ্রয় থাকিবার কারণে জীবাণু নিশ্চিহ্ন হইবে। ইহা মানবজাতির রোগমুক্তির লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাসে আরও একটি জয়স্তম্ভ হইবে, সন্দেহ নাই। নানা রোগের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু মানবশরীরের প্রতিরোধশক্তিকে পরাভূত করিয়া মহামারি ঘটাইত। টিকাকরণ প্রক্রিয়াকে বিপরীত-মহামারি বলা যাইতে পারে, কারণ তাহার সাহায্যে মানবজাতি এখন রোগগুলিকে সমবেত ভাবে আক্রমণ করিয়া নির্মূল করিতেছে। টিকাকরণের যে প্রক্রিয়া এডওয়ার্ড জেনার শুরু করিয়াছিলেন দুই শতক পূর্বে, আজ তাহা মানবজাতির আয়ু ও কর্মক্ষমতা বাড়াইয়াছে।
কিন্তু উদ্দেশ্য মহৎ হইলেও প্রশ্ন ওঠে, প্রচুর খরচে এবং বিপুল পরিশ্রমে হাম নির্মূল করিবার যে প্রয়াস শুরু হইবে, তাহা কি এই কারণে যে শিশুদের অসুখ ও মৃত্যুর ইহাই সর্ববৃহৎ কারণ? না কি, হাম নির্মূলীকরণের লক্ষ্যপূরণ অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য বলিয়া, এবং তাহার সাফল্য তুলনায় নিশ্চিত বলিয়া, তাহার প্রতি আগ্রহ দেখা যাইতেছে? আজ ভারতে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলির মধ্যে রহিয়াছে প্রসবকালীন জটিলতায় নবজাতকের মৃত্যু, নিউমোনিয়া এবং উদরাময়। এই কারণগুলিও প্রতিরোধযোগ্য, উন্নত দেশগুলিতে এই সমস্যাগুলি পরাভূত হইয়াছে। কিন্তু তাহার জন্য জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা পরিষেবার সমন্বয়। পুষ্টি, শৌচব্যবস্থা, পানীয় জল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও আপৎকালীন চিকিৎসা, এমন নানা বিষয়ের যথাযথ সমন্বয় না হইলে এই সকল কারণ হইতে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ সহজ নহে। সেই সমন্বয় নাই, তাই প্রচুর অর্থব্যয় করিয়া জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের উদ্যোগে হাসপাতালে প্রসবসংখ্যা বাড়াইয়াও শিশুমৃত্যুর হার তেমন কমে নাই। টিকাকরণের মতো কোনও একটি উপায় প্রয়োগ করিয়া শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলির প্রতিরোধ করা সম্ভব নহে।
যে কোনও জননীতি প্রণয়নের সময়ে চিন্তা করিতে হইবে, কী মূল্য দিয়া কত সুবিধা পাওয়া গেল? উপর্যুপরি টিকাকরণের দ্বারা জীবাণু নির্মূল করিবার প্রকরণ আয়ত্ত হইয়াছে, তাহার প্রয়োগ সহজ এবং তাহাতে সকলে সহজেই সম্মত হইয়া থাকেন। কিন্তু তাহার দ্বারাই সর্বাধিক সুফল লাভ হইবে, এমন না-ও হইতে পারে। অপর কোনও উপায়ে এই অর্থ ও শ্রম নিয়োজিত করিলে শিশুর মৃত্যুহার, এবং রোগাক্রান্ত হইবার হার আরও দ্রুত কমিত কি না, সেই প্রশ্নও জরুরি। |