প্রবন্ধ...
অন্যায় স্বীকার করলেও অন্যায়টা থেকেই যায়
বিষ্যতে যে ঘটনা ঘটবে, বিশেষত যে কাজ আমরা করতে চলেছি, তা যদি অবাঞ্ছিত, অশুভ, অন্যায়, অকল্যাণকারী হয়, তা হলে অন্তত এখন থেকে যাতে সে রকম ব্যাপার না ঘটে, যাতে আমরা সেই কাজ না করি, তার জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে। আগামী দুঃখকে তাই বাধা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে (যোগসূত্রে তাই রয়েছে ‘হেয়ং দুঃখম্ অনাগতম্’)। কিন্তু অতীতের দুঃখ, অতীতের অন্যায়, অতীতের লজ্জাজনক ঘটনাকে তো আমরা কোনও প্রতিবন্ধক দিয়েই আর থামাতে পারি না।
তবু, চার ভাবে আমরা প্রাক্তন কর্মকে, প্রাক্তন অথচ বাস্তব কুকাজকে, প্রতিরোধ অথবা না-হওয়া করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে থাকি। এই চার রকম অতীত মুছে ফেলার (মিথ্যা, ব্যর্থ করার) উপায় হল:
প্রায়শ্চিত্ত/অনুশোচনা,
প্রতিশোধ,
ফলশ্রুতি তথা অবশিষ্ট চিহ্ন-বিলোপ করা,
বিস্মরণ।
প্রথম দুটি নিয়মিত ভাবে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এখুনি তা দেখাব। (অবশ্য এখানে ‘এখুনি’ শব্দের মানে অদূর ভবিষ্যতে— এর পরের প্যারাগ্রাফে।) তৃতীয়টি নিছক মিথ্যাচার। খুনি যে রকম খুনের সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করে দিয়ে ভাবে, করা খুনটাও কেউ যেন করেনি। অবশ্যই ভুল ভাবে। অন্যকে নয় শুধু, নিজেকেও বঞ্চনা করে। চতুর্থ উপায়টাই আমাদের মূল আলোচ্য।
আমার সাদামাটা সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত এই যে, কোনও ঘটনা সকলে ভুলে গেলেই সেটা বাস্তব চার-আয়াসের (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ ও সময়) বিশ্ব থেকে খসে যায় না, যদিও এক অর্থে সেই চিরবিস্মৃত ঘটনা ইতিহাস থেকে মুছে যায়। অতীতের এই বিরাট অংশটাকে আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাসের ‘অনঙ্গ’ বলা যায়, কারণ ওগুলো ইতিহাসের অঙ্গ নয়। আর এই অনঙ্গের গভীর প্রভাব পড়ে আমাদের বর্তমানের বাস্তব চরিত্রের ওপরে, ঠিক যেমন— ফ্রয়েডের শিক্ষা অনুযায়ী— আমাদের বিস্মৃত শৈশবের অচেতন অমনস্ক অনঙ্গের অতল তরঙ্গাভিঘাত আমাদের আমরণ উদ্বেলিত করতেই থাকে।
প্রায়শ্চিত্ত বা অনুশোচনার দ্বারা অতীতের পাপ ধুয়ে ফেলা যায়, এ কথা শুধু হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে বা রোমান ক্যাথলিক ধর্মাচারে পাওয়া যায় এমন নয়, আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে আমেরিকা তার ক্রীতদাস-কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর কৃত অন্যায়, ভারতবর্ষ অস্পৃশ্য চণ্ডালদের প্রতি কৃত হাজার বছরের অবমাননা ও অত্যাচার, জার্মানরা ইহুদিদের ওপর করা পৈশাচিক অত্যাচারের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ দ্বারা কিছু একটা ‘প্রতিবিধান’ করবার চেষ্টা করেছে, করছে বা করবার কথা আলোচনা করে চলেছে। এই চেষ্টা সর্বৈব নিষ্ফল বলে সাব্যস্ত করবার আগে আমরা দেখতে চাই, পুরনো অপরাধ এখনকার প্রতিকার বা অনুশোচনার দ্বারা কেন আদৌ ‘মিটে যাবে’ (হিন্দিতে যার মানে হয় ‘মুছে যাবে’) বলে আমরা মনে করি?

অতীত ও বর্তমান। পাঁচশো বছর বয়সি বটগাছের নীচে নরেন্দ্র মোদী।
গুজরাত, অগস্ট ২০১৩। ছবি: পি টি আই।
অনুতাপ বা প্রায়শ্চিত্তের একটা প্রধান অঙ্গ হল দুষ্কৃতিকারীর দ্বারা অতীতের কৃত দুষ্কর্মের উদ্ঘাটন বা সখেদ উদ্ঘোষণা। যাকে ইংরেজিতে বলে কনফেশন। ক্যাথলিক চার্চে এই কনফেশনকে সহজতর করার জন্য কেবল এক জন পাদরির কাছে গোপনে পরদার ফাঁক দিয়ে বা ফুটো দিয়ে পাপখ্যাপনের প্রথা আছে। এই প্রথাতে বিকৃতির, ভ্রষ্টাচারের সম্ভাবনা নিয়ে খ্রিস্টানরাই কয়েকশো বছর ধরে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে আসছেন। কিন্তু গোপনতার ও নাম অপ্রকাশের নিরাপত্তার ভরসা না-করে কেউ যদি নিজের অতীতের (অন্যের অজানা) দুষ্কৃতিকে খুলে প্রকাশ করে, তা হলে সেই প্রাচীন কুকর্মের যে প্রধান খারাপত্ব অর্থাৎ লুকিয়ে এমন কাজ করা, যা লোকচক্ষুর সামনে করতে রাজি নই সেই খারাপত্বটা আমরা মুছে দিতে পারি। কিন্তু এই পরবর্তী ক্লেদ-নির্মোচনের প্রতিশ্রুতিতে উৎসাহী হয়ে যদি কেউ ক্রমাগত বাজে কাজ করে নিয়মিত ভাবে পরে পাপখ্যাপন করে যেতে থাকে, তা হলে সেটা সামাজিক ও ব্যক্তিগত সব নৈতিক দিক থেকেই নিতান্ত অবাঞ্ছনীয় হবে।
আসল কথা, যদি পুরনো কাজটার দ্বারা কারও প্রাণবিয়োগ, সন্তানবিয়োগ বা জীবনব্যাপী কায়িক বা মানসিক ক্ষতি হয়ে থাকে, তা হলে দোষী ব্যক্তির নৈতিক শুদ্ধিস্নানের দ্বারা সেই প্রাণ, সেই সন্তান, সেই হারানো সুস্থতা ফিরে তো আর আসে না! বরং ভেবে দেখলে পরে সব থেকে বড় বড় অনুতপ্ত ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্যে ‘আর করব না’ জাতীয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞা যা ভবিষ্যৎমুখী, অতীতমুখী নয় (যদি না অবশ্য কেউ সময়কে চক্রাকার মনে করে, যাতে এমনটা ভাবা যায় যে, আগামী না-করাটাই অতীতের করাটাকে গিয়ে কাটাকাটি করে দিল ওই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং অনুতপ্ত দুষ্কৃতিকারীর আমূল চরিত্র পরিবর্তনের সজাগ প্রতিশ্রুতির থেকে বেশি আর কিছুই থাকতে পারে না।
আমূল চরিত্র পরিবর্তনের ব্যাপারটাও গোলমেলে। আজ যদি নরেন্দ্র মোদী, শুধু প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভে নয়, যথার্থ চরিত্র পরিবর্তনের ফলে জনসমক্ষে গুজরাত গণহত্যার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলেন ‘সেই নরেন্দ্র মোদী মরে গেছে। এখন অনুতাপের আগুনে দগ্ধ নতুন এক ব্যক্তি শুধু বহুজাতিক বাণিজ্যের স্বার্থে নয়, মানবতার খাতিরে সংখ্যালঘু এবং গরিব পথবাসিনী মহিলাদের সেবার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে, আমি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে শিখেছি যে, কোনও স্থায়ী ‘আমি’ বলে কিছু নেই, কাজেই এই নতুন নরেন্দ্রকে আপনারা দলে দলে ভোট দিন’, তা হলে এই নৈরাত্ম্যবাদী অনুতাপের মধ্যে বিরাট বিরাট অন্তর্বিরোধের ফাটল থেকে যাবে। যেহেতু অতীতের আমি নরেন্দ্র মোদী অন্য মানুষ, সেহেতু আমি এ ক্ষেত্রে অন্যের করা কাজের জন্য অনুতপ্ত হতে পারি না। যদি আমি সত্যিই নতুন লোক, তবে আমি সত্যি সত্যি দশ বছর আগেকার কুকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতেই পারি না। অথচ অনুতাপ বা প্রায়শ্চিত্তের আগুনের পরশমণি যাকে দহন দান করবে, তাকেই পুণ্য করবে, অন্য ব্যক্তিকে নয়। তা হলে আমূল আত্মপরিবর্তন আর পূর্বকৃত পাপের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ, এ দুটো একসঙ্গে হতে পারে কি না সন্দেহ। ক্ষণভঙ্গবাদীর পক্ষে পুরনো পাপ কবুল করাটাও মুশকিল।
প্রায়শ্চিত্তের মধ্যে অবশ্য একটা তপস্যা বা স্বেচ্ছায় কষ্টবরণ করার দিক আছে। কর্মবাদের মূল কথা হল, ভাল কাজের ফলে সুখ, আর খারাপ কাজের ফলে দুঃখ হয়। আমি যদি খারাপ কাজ করে থাকি, বুড়ো বয়স বা পরজন্ম পর্যন্ত তার প্রতিফল পাওয়ার অপেক্ষা না-করে তড়িঘড়ি নিজে উপোস-টুপোস করে মাথা ন্যাড়া করে, অথবা ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার কাশীর মহিষী (অসার্থকনাম্নী) করুণার মতো সখীদের সঙ্গে খেটেখুটে গরিবদের জ্বালানো ঘরগুলো পুনর্নির্মাণ করার কষ্ট পেয়ে আমি অদৃষ্টের ঋণ শোধ করতে পারি। অপমানে তাদের সমান হতে পারি, যাদের আমরা বহু শতাব্দী ধরে অপমান করেছি। কিন্তু স্বেচ্ছাকৃত কৃচ্ছ্রসাধন বা তাপ (জৈনরা যেমন নিজের গা থেকে লোম উপড়ে উপড়ে পাপক্ষালন করেন), যতই কঠিন হোক, অন্যের দেওয়া অন্যায় কষ্ট বা অপ্রত্যাশিত আক্রমণ-অপমানের মতন দুঃসহ নয়। পলিনেশিয়ান দ্বীপ সামোআর মানুষের মতন আমরা বলাৎকার বা চুরির শাস্তি হিসেবে ধর্ষক বা তস্করকে ডেকে বাক্-দণ্ড তথা জঘন্য অপমানজনক নিন্দাবাদের দ্বারা তাকে পীড়া দিতে পারি। তাতে ধর্ষিতা রমণীরও এক রকমের প্রতিশোধস্পৃহা মিটতে পারে। কিন্তু অতীতের ধর্ষণ ‘মিটে’ যায় না। যা হয়েছে, তা ‘হয়েছিল’ই থেকে যায়। প্রতিশোধের দ্বারাও যে প্রথমকৃত আক্রমণ বা হত্যাকাণ্ড বা ক্ষতি সমীকৃত হয়ে ‘শোধবোধ’ হয়ে যায় না, তা আমি ভাতকাপড়ের ভাবনা (অনুষ্টুপ ২০১৩) বইয়ের ‘প্রসঙ্গ প্রতিশোধ’ অধ্যায়ে দেখানোর চেষ্টা করছি।
এতক্ষণ কেবল অতীতের খারাপ কাজের কথাই বলছি। অতীতে তো নিজেরা বা অন্যেরা অনেক ভাল ভাল কাজও করেছি বা করেছে! যেমন ধরা যাক, আমাকে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছে বা চাকরি পাইয়ে দিয়েছে দু’বছর আগে এক সদাশয় মহাত্মা। ‘প্রতিফলনাত্মক’ প্রতি-ক্রিয়া করতে পারলে সেই কাজটা যদি মুছে যেত, তা হলে আমি যদি কৃতজ্ঞ হয়ে তাকে উল্টে নেমন্তন্ন করে খাওয়াই অথবা তার দুর্দিনে তাকে চাকরি জুটিয়ে দিই, তা হলে ওই কৃতজ্ঞতার কাজের মূল্য হত ওর করা প্রথম ভাল কাজটির সত্তাবিলোপ। কিন্তু তা হয় না। কৃতজ্ঞ প্রতিদানের দ্বারা আদ্য সৎকর্মটি কাটাকাটি হয়ে যায় না। সে জন্যই কৃতজ্ঞ ব্যক্তি বলে বা লেখে ‘ঋণ শোধের জন্য নয়, ঋণস্বীকারের জন্য’। তা নইলে কৃতজ্ঞতাই হয়ে যেত কৃতঘ্নতা। ওর করা কাজটিকে হত্যা করা।
এত সব বলবার পরেও একটা কথা বাকি থেকে যায়। খারাপ কাজ, ভাল কাজ, দু’রকম কর্মই খ্যাপন বা ঘোষণার দ্বারা কেমন ‘কমে আসে’ বলে মনে হয়। ‘আমি গত বছর আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলাম’, এটা ক্ষতিগ্রস্ত সহকর্মীকে বলার ফলে পিছন থেকে ছুরি মারাটার পাপ-মূল্য কমে আসে। ‘আমি কেদার-বদ্রির বন্যা দুর্বিপাকে এক লক্ষ টাকা সাহায্য দিয়েছি’, এ কথা ঘোষণা করলেও তেমনই দানের পুণ্য-মূল্য কমে আসে। বিজ্ঞাপনের দ্বারা পণ্যকে ঝলমলে করা হয়তো বা যায়, পুণ্যকে উজ্জ্বলতর করা যায় না। বিজ্ঞাপিত হলে পুণ্য ম্যাড়মেড়ে হয়ে আসে। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই মানোয়া’য় দর্শনের অধ্যাপক

(চলবে)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.