অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সাত মাসের মধ্যে দিল্লি গণধর্ষণের বিচার সম্পন্ন করিয়া ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত আপন নামের মর্যাদা বহুলাংশে রক্ষা করিয়াছে। এ দেশে সচরাচর এত শীঘ্র ধর্ষণ ও হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয় না। না হওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ হিসাবে বার বার যে সমস্যাগুলির কথা বলা হয় তাহাদের মধ্যে আছে পুলিশের অভিযোগ লইতে না-চাওয়া, তদন্তে গাফিলতি, অভিযুক্তদের শনাক্ত বা গ্রেফতার করার ব্যাপারে অন্তহীন গড়িমসি এবং সময় মতো চার্জশিট গঠনে শৈথিল্য। দিল্লির ঘটনাটির বিচারে যে এই বিষয়গুলি তত বাধা হইয়া দাঁড়ায় নাই, তাহার কারণ ওই পৈশাচিক অপরাধের বিরুদ্ধে দেশময় প্রতিবাদ, ধিক্কার ও আন্দোলন এবং দোষীদের কঠোরতম শাস্তির দাবি। শেষ পর্যন্ত প্রবল জনমতের চাপে পুলিশ প্রশাসন হইতে শুরু করিয়া আদালত পর্যন্ত সকল স্তরেই তৎপরতা লক্ষিত হয় এবং অপরাধীদের শাস্তির নিদানও যথাসময়ে হইয়া যায়। ইহা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ঘটনা।
কিন্তু এই বিচারপ্রক্রিয়াই দেখাইয়া দেয়, এই ধরনের জঘন্য অপরাধের বিচার ও শাস্তিতে কতখানি তৎপরতা আবশ্যক। ধর্ষক ও ঘাতকের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা নির্ভয়ার বেলায় সমাজে সঞ্চারিত হইয়া পুলিশকেও অংশত প্রভাবিত করে, অন্যান্য ধর্ষণের বেলায় তাহা কদাচিৎ দেখা যায়। দৃষ্টান্ত গনিয়া শেষ করা যাইবে না। বহু ক্ষেত্রেই পুলিশ বিলম্বিত, দায়সারা, ক্ষেত্রবিশেষে পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ করে। অনেক সময়েই ধর্ষিতার চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করিয়া ধর্ষক-ঘাতককে প্রকারান্তরে আড়াল করা হয়। কেবল এই রাজ্যে নয়, সারা দেশেই ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের এ ধরনের ধিক্কারযোগ্য আচরণ একটি লক্ষণীয় প্রবণতা। তদুপরি আছে বিচারপ্রক্রিয়ার সুপরিচিত দীর্ঘসূত্রিতা। ফলে ন্যায়বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হইয়া ওঠে। একে তো আজও, এই একবিংশ শতকেও সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধসঞ্জাত লোকলজ্জা এবং সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে নির্যাতিতা মহিলারা তাঁহাদের বিরুদ্ধে অপরাধী দুর্বৃত্তদের চিনাইয়া দিতে দ্বিধা করেন। উপরন্তু পুলিশের তরফে নির্যাতিতার প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার বদলে মমত্বহীন দুর্ব্যবহার তাঁহাদের আরও সংকুচিত করিয়া তোলে। ন্যায়ালয়ে লড়াই চালাইবার সঙ্কল্প ও সাহস, দুইই তাঁহারা হারাইয়া ফেলেন। ধর্ষণে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করিয়া বিচারের সম্মুখীন করার জন্য তুমুল গণ-আন্দোলনের প্রয়োজন হইবে কেন? কেন কামদুনির মহিলাদের কলিকাতায় আসিয়া ন্যায়বিচারের দাবিতে পুলিশের লাঠি-চার্জ হজম করিতে হইবে? আইনের শাসন ও স্বাভাবিক বিচার-প্রক্রিয়াই অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করা এবং শাস্তিদানের জন্য পর্যাপ্ত হইবে না কেন?
দুর্ভাগ্যবশত, এ দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধকারী দুষ্কৃতীদের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং শাস্তি পাওয়ার ঘটনা লজ্জাজনক ভাবে কম। জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসাবে দেখা যাইতেছে, গত বছর যে পঁচিশ হাজার ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়, তাহার মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশেরও কম ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হয়। এই লজ্জাকর পরিসংখ্যানের পিছনে আদালত তথা বিচারব্যবস্থার ভূমিকাও কি খুব অনুল্লেখ্য? পুলিশকে সক্রিয় ও তৎপর করার দায় যেমন শাসক দলের, তেমনই আদালতেরও নয় কি? নিগৃহীতাকে সাহস, নিরাপত্তা ও কলঙ্কহীনতা প্রদানের দায়িত্বও সমাজের তরফে আইনি ব্যবস্থারই। ধর্ষণকারীকে শাস্তিযোগ্য, ঘৃণ্য অমানুষ হিসাবে উপর্যুপরি তুলিয়া ধরার মধ্যেই ধর্ষিতার সামাজিক কলঙ্কমোচনের চাবিকাঠি নিহিত। তাঁহারা যে নিজেদের যন্ত্রণা ও অসম্মানের কাহিনি বর্ণনা করিতে আগাইয়া আসিবেন, তাঁহার পরিবার এবং সমাজকেও তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। |