কপাল ফিরছে পিছিয়ে পড়া বীরভূম জেলার। সেই সঙ্গে রাজ্যেরও। বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকে পাথর এবং কয়লা তোলার সবচেয়ে বড় প্রকল্পে নামতে চলেছে রাজ্য। বুধবার মন্ত্রিসভার শিল্প-পরিকাঠামো-কর্মসংস্থান বিষয়ক বিশেষ কমিটির বৈঠকে এই প্রকল্পে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা এবং তার আশপাশের গ্রামের মাটির নীচে ২১০ কোটি ২০ লক্ষ টন কয়লা মজুত রয়েছে। কিন্তু তা এতটাই নীচে রয়েছে যে, এত দিন তোলা সম্ভব হয়নি। এ দিন রাজ্য মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দরপত্র চেয়ে এই কাজে অভিজ্ঞ খনন সংস্থা নিয়োগ করা হবে। এবং কয়লার সঙ্গে ওই খনি এলাকার পাথরও তোলা হবে। এই প্রকল্পে লগ্নি হবে আনুমানিক ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটির ফলে রাজ্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা জোগানে আর কোনও সমস্যাই থাকবে না। ফলে বিদ্যুতের দাম রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এই প্রকল্প নিয়ে এর মধ্যেই যথেষ্ট আশাবাদী সরকারি শীর্ষ কর্তারা। তাঁরা মনে করছেন, এই কর্মকাণ্ডের ফলে বীরভূমের মতো পিছিয়ে পড়া জেলার আর্থিক হাল তো ফিরবেই, তা ছাড়া রাজ্যের অর্থনীতির উপরেও এর বড় প্রভাব পড়বে। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দেউচা-র প্রকল্পটি রাজ্যের অর্থনীতির হাল ফেরাতে বিশেষ সহায়ক হবে। সে জন্য রাজ্য খনিজ উন্নয়ন এবং বাণিজ্য নিগমকে ঢেলে সাজতে হবে। কারণ, তারাই রাজ্যের নিজস্ব সর্ববৃহৎ পাথর-কয়লা তোলার প্রকল্পটি চালাবে।” এক সরকারি কর্তা জানান, প্রকল্পের মাধ্যমে এক দিকে কয়েক হাজার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে। অন্য দিকে, এখান থেকে যে কয়লা ও পাথর তোলা হবে, তা বিক্রি করে সরকার বছরে সেস, রয়্যালটি ও ভ্যাট বাবদ কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবে। |
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর এখন দিল্লি থেকে কয়লা মন্ত্রকের চূড়ান্ত ছাড়পত্র এলেই রাজ্য খনিজ উন্নয়ন ও বাণিজ্য নিগম বীরভূমের মাটিতে পাথর-কয়লা তোলার প্রকল্পে হাত দেবে।
মহাকরণ সূত্রের খবর, এই বছর ৭ জুন কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্টার-মিনিস্টারিয়াল বা আন্তঃমন্ত্রক কমিটির পঞ্চম বৈঠকে বলা হয়েছিল, যে হেতু ব্লকটি পশ্চিমবঙ্গে, তাই তারাই কয়লা তুলে অন্য রাজ্যকে সরবরাহ করতে পারে। সেপ্টেম্বরে কয়লা মন্ত্রক বীরভূমের দেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা কয়লা ব্লকটি ছ’টি রাজ্যের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমকে বরাদ্দ করে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও কর্নাটক, বিহার, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশকে এখান থেকে কয়লা নেওয়ার অধিকার দেয় কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ কয়লা তুললে কেন্দ্রের নির্দেশমতো এই রাজ্যগুলিকে তার ভাগ বিক্রি করবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু এই কয়লা কী ভাবে তোলা হবে, তা নিয়ে এত দিন কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিতে দেরির কারণ, এখানে কয়লা তোলার ব্যাপারটি একেবারেই সহজ নয়। জিওলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেউচা ব্লকে মজুত কয়লা রয়েছে ভূগর্ভের ৩৩০ মিটার থেকে ৩৯০ মিটার পর্যন্ত স্তরে। তার আগে পর্যন্ত রয়েছে কালো পাথর। সাধারণত খনিতে কয়লা স্তরের গভীরতা হয় ১৩০ থেকে ২০০ মিটার। ফলে এত নীচ থেকে কয়লা তোলার দক্ষতা দেশের কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার নেই। শুধু অস্ট্রেলিয়া বা হল্যান্ডের কিছু সংস্থার এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। সরকারি কর্তারা বলছেন, একটি পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে, কতটা কালো পাথরের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে এই কয়লার স্তর। তাঁরা জানাচ্ছেন, কয়লার স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে যে পরিমাণ কালো পাথর তুলতে হবে, তাতে ওই এলাকায় অন্তত ২০০টি পাথর ভাঙার কল (ক্রাশার) বসাতে হবে। কিন্তু এই পাথরই শাপে বর হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ওই কর্তাব্যক্তিরা। কারণ, তা বেচেও প্রচুর টাকা আয় করতে পারবে সরকার। এক কর্তার সহাস্য মন্তব্য, “কয়লার উপরের স্তরকে পরিভাষায় বলা হয় ওভার বার্ডেন বা বোঝা। এখানে দেখা যাচ্ছে, বোঝা-ই হচ্ছে সম্পদ।” তা ছাড়া, এখান থেকে যে কয়লা মিলবে, তা তাপবিদ্যুতের জন্য উপযুক্ত ভাল মানের কয়লা বলেই জানিয়েছে সরকারি সূত্র। বিদ্যুৎ কর্তারা একে বলছেন, “কালো হিরের খনি।”
এ দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঠিক হয়, আন্তর্জাতিক দরপত্র চেয়ে খনন কাজের জন্য কোনও মাইন ডেভেলপার অ্যান্ড অপারেটর (এমডিও) নিয়োগ করতে হবে। রাজ্য খনিজ উন্নয়ন এবং বাণিজ্য নিগমই এই এমডিও নিয়োগ করবে। তারাই দেউচা এলাকার কালোপাথর এবং কয়লা তোলার কাজ করবে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের এক কর্তা জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের সব ক’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মিলিয়ে এখন কয়লার প্রয়োজন হয় বছরে ১ কোটি ৮০ লক্ষ টনের মতো। তার মধ্যে কোল ইন্ডিয়ার কাছে কিনতে হয় প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ টন। এর পরে শুধু দেউচা থেকেই মিলবে বছরে ২ কোটি ৪০ লক্ষ টন কয়লা। ফলে কোল ইন্ডিয়ার উপরে ভরসা করতে হবে না। বিদ্যুৎ কর্তারা জানাচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচের রাশ থাকবে নিজেদের হাতে।
এ দিন বণিকসভা সিআইআই আয়োজিত বিদ্যুৎ শিল্প নিয়ে এক আলোচনাসভাতেও রাজ্যের বিদ্যুৎসচিব মলয় দে জানান, আগামী দিন রাজ্যের হাতে নিজেদের খনি ও কোল ইন্ডিয়া মিলিয়ে মোট কয়লা পাওয়া যাবে বছরে ৫ কোটি ৬০ লক্ষ টন। তা দিয়ে কমপক্ষে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। ফলে রাজ্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার জোগানের আর কোনও সমস্যা থাকবে না।
প্রকল্প এলাকার অবস্থান কেমন? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “মহম্মদবাজার ব্লকের এই গ্রামগুলিতে চাষাবাদ প্রায় হয় না। প্রথম পর্যায়ে যে হাজার একর জমির প্রয়োজন, তার মধ্যে ৫০-৬০ একর একফসলি চাষের জমি। বাকি জমি রুক্ষ এবং পতিত। তবে এলাকায় বেশ কিছু বনাঞ্চল এবং পাহাড়ি এলাকা রয়েছে। ফলে পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র লাগবে।” তিনি জানান, প্রকল্প এলাকার মধ্যে ১০-১২টি আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে বিকল্প আয় তথা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেই এগোতে চায় রাজ্য। সে জন্য জেলা প্রশাসন বছর দুই আগেই প্রাথমিক সমীক্ষা করে রেখেছে।
প্রকল্পে কী পরিমাণ বিনিয়োগ হতে পারে?
শিল্প দফতরের এক কর্তা জানান, বছর চারেক আগে অস্ট্রেলিয়ার এক খনন সংস্থা ৫৪ হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব দিয়ে দেউচা ব্লক পেতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন কয়লার ব্লক পাওয়া যায়নি বলে তারা এগোয়নি। রাজ্যে পরিবর্তন আসার পরে ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএমডিসি)-কে সঙ্গে নিয়ে কোল ইন্ডিয়া বীরভূমের খনিটিতে ‘কোল-টু-লিকুইড’ (কয়লা থেকে বিভিন্ন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য উৎপাদন) নামে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, ওই খনিটির কয়লা থেকে মূলত পেট্রোল ও ডিজেল তৈরি করা হবে। এই প্রকল্পে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বহুজাতিক সংস্থা। প্রস্তাবটি গৃহীত হলে এটি হতো দেশের মধ্যে প্রথম এমন ধরনের প্রকল্প। বিষয়টি জানার পর মুখ্যমন্ত্রীই চিঠি লেখেন কয়লা মন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জায়সবালকে। তবে পরে প্রস্তাবটি নানা কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়। সেই কয়লা ব্লকটিই কয়লা মন্ত্রক এখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের জন্য বরাদ্দ করেছে।
সরকারি সূত্রের খবর, গত বছরই জমি অধিগ্রহণ করা হবে না বলে কুলটির কাছে দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া (পূর্ব) কয়লা খনি নেয়নি রাজ্য। খনিটিতে ৩০ কোটি টনের মতো কয়লা ছিল, যার বেশির ভাগটাই দামি কোকিং কয়লা (যা ইস্পাত শিল্পে চড়া দামে বিক্রি হয়)। পাওয়া যেত নন-কোকিং কয়লাও। এখন সেই খনিতে কাজ শুরু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত কোকিং কোল। সেখানে জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে স্থানীয়দের বাধার মুখেও পড়তে হয়নি তাদের।
দামাগোড়িয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেউচা আর হাতছাড়া করতে চাইছে না রাজ্য। |