বর্ধমান শহর মরুভূমি নয়। হাত বাড়ালেই তৃষ্ণার জল মেলে, তেমনটাও নয়।
সিপিএমের প্রচার পুস্তিকা বলছে: ‘সকল নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিতে পুরসভা প্রত্যহ সাত ঘণ্টা করে জল সরবরাহ করে থাকে। ১৯৮৮ সালে ছিল ১২টি গভীর নলকূপ, বর্তমানে পুরসভার ৫৯টি গভীর নলকূপ রয়েছে। পুরসভা প্রতি দিন জল সরবরাহ করে এক কোটি গ্যালন। জলের সংযোগ রয়েছে ২৫০০০টি বাড়িতে। এছাড়া ৯১৩১টি রাস্তার কল রয়েছে। সব মিলিয়ে পাইপলাইন রয়েছে ৩৫০ কিলোমিটার।’
বর্ধমান পুরসভার সচিব জয়রঞ্জন সেনের দাবি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মাপকাঠিতে প্রতিটি পুরসভার বাসিন্দাদের দৈনিক ১২০ লিটার জল সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় মাপে তা দৈনিক মাথা পিছু ১০০ লিটারে দাঁড়িয়েছে। বর্ধমান পুরসভা শহরে গড়ে প্রতি দিন ৮০ থেকে ৯০ লিটার পানীয় জল সরবরাহ করে। এত বেশি জল সরবরাহ পুরসভার ক্ষেত্রে একটা রেকর্ড।
অথচ জলাভাবকেই পুরভোটের প্রচারে অন্যতম হাতিয়ার করেছে তৃণমূল। তার মধ্যে অগুনতি বস্তির জলসঙ্কট অন্যতম। বর্ধমানে নির্বাচনী সভায় এসে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অভিযোগ করেছেন, “এখানে অসংখ্য বস্তিতে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেনি পুরসভা।” আর এক মন্ত্রী তথা বর্ধমান দক্ষিণের বিধায়ক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় প্রায় ফাটা রেকর্ডের মতোই জল নিয়ে আক্ষেপ করে চলেছেন সমস্ত নির্বাচনী জনসভায়।
বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান রবিরঞ্জনবাবুর কথায়, বলছেন, “পুর এলাকার ৩৫টি ওয়ার্ডের মানুষের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে দামোদর থেকে জল তুলে একটি বড় জলপ্রকল্প গড়তে চেয়েছিলাম। টাকা নয়, জমি নয়, আমরা শুধু পুরসভার ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট চেয়েছিলাম। সেটাও ওরা দেয়নি। এটা কি রাজনীতি করতে গিয়ে মানুষকে বঞ্চিত করা নয়?” |
যথাসময়ে ভোট না হওয়ায় বিগত বাম পুরর্বোডের সমস্ত সদস্যকেই পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এর পরে পানীয় জলের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনও বিতর্কে যেতে চাইছেন না প্রাক্তন জনপ্রতিনিধিরা। তবে পুরসভা সূত্রে তথ্য দিয়ে তৃণমূলের অভিযোগ খণ্ডন করা হয়েছে। তাদের দাবি, বর্তমানে পুর এলাকায় মোট ৫৬টি গভীর নলকূপ, ৬টি জলাধার, ২১৮৬টি নলকূপ ও ৭২০৭টি রাস্তার কল রয়েছে। জল সরবরাহ করা হয় ২৫২৩২টি বাড়িতে। ফলে জলের অভাব কার্যত নেই।
বিগত পুরসভার বিরোধী দলনেতা, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী সমীর রায়ের পাল্টা প্রশ্ন, “পানীয় জলের যদি অভাবই না থাকে, তা হলে পুরসভা গত এক বছর ধরে বাড়িতে পানীয় জলের লাইন দেওয়া বন্ধ রেখেছে কেন?” পুরসভা সূত্রে তা স্বীকার করা হয়নি, কোনও ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। শুধু জানানো হয়েছে, শীঘ্রই ফের বাড়িতে জলের লাইন দেওয়া চালু করা হবে।
বস্তুত, বর্ধমান শহরের একটা বড় অংশেই যে বাড়ি ও রাস্তায় জল সরবরাহ মোটামুটি ঠিকই আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। লোডশেডিং না হলে জল পেতে বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত নাগরিকের বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তৃণমূল আসলে পাখির চোখ বস্তি এলাকার ভোটব্যাঙ্ককে। বাড়ির কর দেওয়ার রসিদ না থাকলে জলের লাইন দেয় না পুরসভা। তাই বস্তি এলাকার বড় অংশেই বাড়িতে জলের লাইন নেই। বস্তিবাসী নিম্নবিত্ত মানুষের সেই অভাববোধই তৃণমূল উস্কে দিতে চাইছে। তবে শহরের মধ্যবিত্ত পাড়ার মতো বস্তি এলাকাতেও সমান হারে জল দিতে গেলে যে সরবরাহে টান পড়বে, তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই।
সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা যে করা যায়নি তা বিগত পুরবোর্ডও ভাল ভাবেই জানত। সিপিএমের পুস্তিকায় লেখা হয়েছে, ‘পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে দামোদর থেকে জল উত্তোলন করে তা পরিশ্রুত করে জল সরবরাহ করার।’ রবিঞ্জনবাবুর অনুযোগ, “আমরা জানি, পুরসভার হাতে জায়গা রয়েছে। সমস্ত পরিকাঠামো রয়েছে। তবু ওরা আমাদের ১২০ কোটি টাকার জলপ্রকল্পের জন্য ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দিল না। সিপিএম পুরসভায় থাকলে আমরা কোনও কাজই করে উঠতে পারব না। ওদের জন্যই বর্ধমানের মানুষের পানীয় জলের সমস্যা মিটছে না।”
কেন সার্টিফিকেট দেয়নি বাম পুরবোর্ড?
সিপিএমের পুস্তিকা বলছে, ‘বর্ধমান শহরের পানীয় জলের সমস্যা দূরীকরণে বর্ধমান পুরসভা নিজস্ব উদ্যোগে ১০৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প রাজ্য সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠায়। কিন্তু রাজ্য সরকার অনুমোদন না দিয়ে চিঠি দিয়ে জানায় বে-সরকারি মালিকদের দিয়ে পি পি পি মডেলে এই জলপ্রকল্প করতে হবে। একটি প্রকল্প ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার আমরা নীতিগত ভাবে বিরোধী। এর ফলে শুধু পুরসভার বহু মূল্যবান সম্পত্তি বে-সরকারি মালিকদের হাতে চলে যাবে তা-ই নয়, জলের জন্য যে কর নাগরিকদের দিতে হবে, তা নাগরিকদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।’
রবিরঞ্জনবাবুও মেনে নেন, “পানীয় জল সরবরাহের খরচ মেটাতে মানুষকে কিছু কর দিতে হবে ঠিকই। কিন্তু তা কত, তা এখনও ঠিক হয়নি।” জলের জন্য যদি সত্যিই কর লাগে, তা মধ্যবিত্তের তুলনায় বস্তিবাসীর পক্ষে বহন করাই বেশি দুরূহ। তবুও বিধায়কের প্রশ্ন, “কত কর লাগবে না জেনেই সিপিএম কী করে বলছে, তা মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়?”
ভোটের রাজনীতির জল বড় ঘোলা, পানের অযোগ্য। |