স্কুলের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে শুধু উদ্বেগ বা আতঙ্ক নয়, শারীরিক কষ্টও ছিল ঐন্দ্রিলার। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে পেট ব্যথার কথা বাড়িতে জানিয়েছিল ঐন্দ্রিলা। মৃত্যুর এক দিন আগে স্থানীয় নার্সিং হোমে তার রক্ত পরীক্ষাও করা হয়। সেই পরীক্ষার যে রিপোর্ট আনন্দবাজারের হাতে এসেছে, তা প্যাংক্রিয়াটাইটিসেরই ইঙ্গিত দেয় বলে চিকিৎসক মহলের দাবি।
ওই রিপোর্ট দেখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, ‘অ্যাকিউট প্যাংক্রিয়াটাইটিস’ অনেকটা হার্ট অ্যাটাকের মতো। যে কোনও মুহূর্তে তা মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। ঐন্দ্রিলার ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়েছিল কি না, তা অবশ্য তার প্যাথলজিক্যাল ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই স্পষ্ট হবে বলে ওই চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
ঐন্দ্রিলা যে মাঝেমাঝেই বাড়িতে পেট ব্যথার কথা বলত, তা অবশ্য জানিয়েছেন তার বাবা শান্তনু দাসও। তবে বিষয়টি যে এতটাই গুরুতর হয়ে উঠেছে তা তাঁরা বুঝতে পারেননি বলে শান্তনুবাবুর বক্তব্য। তিনি এ দিন বলেন, “পেট ব্যথার কথা মাঝেমধ্যে মেয়ে বলত ঠিকই, কিন্তু প্রবল কোনও কষ্টের কথা সে বলেনি।” শান্তনুবাবু জানিয়েছেন, ঐন্দ্রিলা চাউমিন, মোমো ইত্যাদি কেনা খাবার খেতে খুব ভালবাসত। প্রায়ই তা খেতও। শান্তনুবাবু বলেন, “ভাবতাম, ওই সব খাবারের জন্যই পেট ব্যথা হচ্ছে। তাই বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিইনি।”
কী রয়েছে ঐন্দ্রিলার বায়োকেমিস্ট্রি রিপোর্টে?
১০ সেপ্টেম্বর, মারা যাওয়ার আগের দিন তার রক্ত পরীক্ষা করে লাইপেজ এবং অ্যামাইলেজ বেশি মিলেছিল বলে রিপোর্টে লেখা হয়েছে। সাধারণ ভাবে রক্তে লাইপেজ থাকার কথা ১৯০ ইউনিট প্রতি লিটার পর্যন্ত। কিন্তু ঐন্দ্রিলার রক্তে তা পাওয়া গিয়েছে ৪৬২। অর্থাৎ, স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি। অন্য দিকে, রক্তে অ্যামাইলেজের স্বাভাবিক মাত্রা ৯০ ইউনিট প্রতি লিটার পর্যন্ত। ঐন্দ্রিলার রক্তে তা মিলেছে ১২৬। এ ছাড়াও ঐন্দ্রিলার টোটাল লিউকোসাইট কাউন্ট প্রতি ঘন মিলিমিটারে ২০ হাজারেরও বেশি। স্বাভাবিক ভাবে এই মাত্রা প্রতি ঘন মিলিমিটারে ৪ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে থাকা উচিত বলে চিকিৎসকদের বক্তব্য।
|
ঐন্দ্রিলার এই রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট থেকে কী বুঝছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা?
গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, “যদি কারও পেটে ব্যথা হয় এবং রক্তে লাইপেজ লেভেল খুব বেড়ে থাকে, তা হলে ধরে নিতে হবে সেটা প্যাংক্রিয়াটাইটিসেরই ইঙ্গিত। সে ক্ষেত্রে দ্রুত কোথাও ভর্তি করিয়ে তার চিকিৎসা শুরু করা দরকার। না হলে ওই রোগই মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।”
গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট অশোকানন্দ কোনারও বলেন, “পেট ব্যথা, লাইপেজ লেভেল বেশি থাকলে প্যাংক্রিয়াটাইটিসেরই সঙ্কেত দেয়। সে ক্ষেত্রে টোটাল লিউকোসাইট কাউন্টও বেশি থাকার কথা (যা ঐন্দ্রিলার রিপোর্টে মিলেছে)।” শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষও বলেন, “কোনও শিশুর রিপোর্টে এ রকম অস্বাভাবিকতা থাকলে তা প্যাংক্রিয়াটাইটিসের দিকে যাচ্ছে বলেই মনে করা হয়।” গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট গোপালকৃষ্ণ ঢালি বলেন, “লাইপেজ লেভেল বেশি থাকার পাশাপাশি যদি পেটে ব্যথার উপসর্গও থাকে, তা হলে প্যাংক্রিয়াটাইটিস বলেই মনে করা হয়। এই পেটে ব্যথার নির্দিষ্ট ধরন থাকে। শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। তার পরে আবার কমে আসে।
খাওয়ার পরে এবং চিৎ হয়ে শুলে ব্যথাটা বেশি হয়।
চিকিৎসকদের দাবি, রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট এবং যতটুকু ‘ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রি’ সামনে এসেছে, তা থেকে এটা পরিষ্কার যে তার শারীরিক সমস্যা বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি না করলে কি কোনও বড় ক্ষতি হতে পারে? গোপালকৃষ্ণর জবাব, “অবশ্যই সেই আশঙ্কা রয়েছে। প্যাংক্রিয়াটাইটিস হলে শরীরে জল খুব কমে যায়। তাই দ্রুত শিরার মধ্যে ফ্লুইড চালু করা দরকার। না হলে আচমকা হার্ট ফেলিওর হতে পারে।”
মনোরোগ চিকিৎসক পার্থসারথি বিশ্বাস যখন ঐন্দ্রিলাকে উদ্বেগ কমানোর ইঞ্জেকশনটি দেন, তখন তিনিও কিন্তু জানতেন যে তার লাইপেজ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি। এক জন চিকিৎসক হিসেবে তিনি কেন ওই রিপোর্ট এবং পেটে ব্যথার উপসর্গকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে শুধু আতঙ্ক এবং উদ্বেগকেই গুরুত্ব দিলেন? পার্থসারথিবাবুর বক্তব্য, তাঁর প্রেসক্রিপশনে তিনি কোনও ফিজিশিয়ানকে দ্রুত দেখানোর কথা লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই রিপোর্টের ব্যাখ্যা ঠিক কী হতে পারে, সেটা কি তিনি মেয়েটির বাবা-মাকে বুঝিয়েছিলেন? ঐন্দ্রিলার বাবা শান্তনু দাসের দাবি, পার্থসারথিবাবু তেমন কিছুই তাঁদের বলেননি। বরং ওই ইঞ্জেকশনটি তিন দিন নিলেই ঐন্দ্রিলা ভাল হয়ে উঠবে এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। ইঞ্জেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কি না এবং কোথাও ভর্তি রেখে ইঞ্জেকশন দেওয়া জরুরি কি না, তেমন কোনও তথ্যও তিনি দেননি।
ঐন্দ্রিলার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তার স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রীদের দুর্ব্যবহার বা স্কুল কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যের অভিযোগ বার বার সামনে এসেছে। সে সবের জেরে কী ভাবে ঐন্দ্রিলা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল, সামনে এসেছে সেই তথ্যও। কিন্তু তার শরীরে কোনও জটিল রোগ বাসা বাঁধতে পারে, তেমন আশঙ্কার কথা সে ভাবে সামনে আসেনি।
১১ তারিখ সকালে ঘুম থেকে ডাকার পরেও চোখ মেলে তাকাতে পারছিল না ঐন্দ্রিলা। তার শরীরের অবনতি হচ্ছে বুঝতে পেরে বাড়ির লোকেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পথেই নেতিয়ে পড়েছিল সে। হাসপাতালে যাওয়ার পরে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। |