|
|
|
|
অসহায় শিশুদের স্নেহের আশ্রয় নিঃসন্তান দম্পতির |
অমিত কর মহাপাত্র • হলদিয়া |
পাঁচ বছরের দীপু সিংহের বাবা খুন হওয়ার পর মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। মামা-দাদুদের কাছে পান থেকে চুন খসলেই কপালে জুটত বেধড়ক পিটুনি। ৯ বছরের অনাথ আকাশ কুণ্ডুর দিন কাটত চায়ের দোকানে ফরমায়েশি খেটে। আর ভিখারি মায়ের ছেলে চার বছরের রঞ্জিৎ চক্রবর্তীর খাবার জুটক না অধিকাংশ দিনই। এমনই কুড়ি জন অনাথ, ভবঘুরে, দুঃস্থ শিশু এখন খেলে বেড়াচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের বেতকুণ্ড এলাকার দেউলপোতা গ্রামের গৌতম ও স্বপ্না বটব্যালের আশ্রমে। তাঁদের সন্তান স্নেহে লালন-পালন করছেন ওই নিঃসন্তান দম্পতি ও তাঁর পরিবার।
পেশায় গ্রামীণ পোস্টমাস্টার ৪৩ বছরের গৌতমবাবু ১৯৯০ সালে কয়েক জনকে নিয়ে দেউলপোতা সেবা সমিতি গড়ে তোলেন। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কাজ করার পাশাপাশি ২০০৯ সালে পরিবারের জমিতেই গড়ে তোলেন শিশুশিক্ষার স্কুল। পরের বছরই বাবা বিমলেন্দুবাবু ও মা অনুরূপাদেবীর সহমতে বাড়ি সংলগ্ন এক জায়গায় গড়ে তোলেন ‘অনাথ আশ্রম’। তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছি। চৈতন্যপুর বিবেকানন্দ মিশনের সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে এসে সেবাকাজে উদ্বুদ্ধ হই। পরিবারের কাছ থেকে উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়ে আশ্রম গড়ি।” তাঁর বাবা বিমলেন্দুবাবু আশ্রম, স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের জন্য পাঁচ ডেসিমেল জমি সমিতিকে দান করেছেন। সেখানেই গড়ে উঠেছে দোতলা পাকা বাড়ির আশ্রম। |
|
খুদেদের সঙ্গে গৌতম ও স্বপ্না বটব্যাল। —নিজস্ব চিত্র। |
তিনি বলেন, “ছেলে-বৌমার কাজে গর্ব হয়। এত নাতি দেখে প্রাণ ভরে যায়।” শিশুদের জন্য মুক্তহস্ত হয়েছেন গ্রামের গৌরী মাইতি, মিনু ঘড়া, তাপসী বেরারা। তাঁরা প্রতিদিন চাল জমিয়ে নিয়ে যান আশ্রমে। শুধু চাল, সব্জি, পুকুরের মাছ নয়, শিশুদের আদর-যত্ন, স্নান করানো, অসুখ-বিসুখে সেবাযত্ন করার জন্যও ছুটে আসেন মোনা মাজি, পুতুল মাইতিদের মতো মায়েরা।
সাহায্য, সহযোগিতা নিয়ে সমবায় পদ্ধতিতে চলে এই আশ্রম। গেঁওখালির প্রবীণ শিক্ষক অনিরুদ্ধ জানা, গিরিশমোড়ের বাসিন্দা আই ও সি-র প্রাক্তন জনসংযোগ আধিকারিক শম্ভুনাথ সাঁতরা, সুতাহাটার বাসিন্দা আইনজীবী অলকেশ সুকুল সকলেই অর্থ সাহায্য করছেন প্রথম থেকেই। তাঁরা বলেন, “আশ্রমের প্রথম থেকেই পাশে আছি। পরেও থাকব। ওই দম্পতি শিশুদের মধ্যেই যেন ভগবানকে খুঁজে পেয়েছেন। সততার সঙ্গে এমন নিঃস্বার্থ সেবা আজকাল দেখাই যায় না।” আশ্রমের ভবন সংস্কারের জন্য হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ দিয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। ক্রমশ আশ্রমের সদস্য হয়েছেন ৪০ জন। তাঁরা ও অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অর্থ, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ওষুধ, শিক্ষার উপকরণ দিয়ে শিশুদের নিয়মিত সাহায্য করে। মহিষাদলের বাসিন্দা পেশায় চিকিৎসক অমিত প্রধান যাবতীয় ওষুধ জোগান দেন। কলকাতার মানিকতলার বাসিন্দা কৃষ্ণগোপাল পাল দেন পড়ার খরচ ও উপকরণ। তাঁরা বলেন, “ওই শিশুরা আমাদের সন্তান। আরও শিশু এলেও আমরা পাশে থাকব।”
যে ছোট ছোট শিশুগুলির জন্য এত আয়োজন তাদের মধ্যে দশ বছরের বিশ্বনাথ রায়, শঙ্কর সিংহ, বারো বছরের সহদেব ঘোড়ইরা বলে, “বাড়িতে এমন করে কেউ ভালবাসে না। আমরা ভাইরা মিলে পড়ি, খেলি, ছবি আঁকি, গান শিখি। কাকু-কাকিমা, দাদু-দিদাকে ছেড়ে কোথাও যাব না আমরা।” এই শিশুরা একে অপরের প্রতি এতই যত্নবান যে, বড়রা ছোটদের কোলে নেয়, ঘুম পাড়ায়, কাছে শোয়, বাথরুমের জন্য জল তুলে দেয়, অসুস্থ জনের সেবাও করে। এত আনন্দ ও সুখের মাঝেও আর্থিক অক্ষমতার জন্য শিশুদের আরও স্বাচ্ছন্দ্য দিতে না পারার জন্য আক্ষেপ রয়েছে গৌতমবাবু ও স্বপ্নাদেবীর। কারণ শিশুদের প্রয়োজন আরও খোলামেলা পরিবেশ, খেলার মাঠ, ঘর, ও আনুসঙ্গিক কিছু ব্যবস্থা। যেমন একটা ঘরেই থাকে শিশুরা। সমিতির কর্মকর্তা অনিল ঘড়া, অলকেশ চক্রবর্তীরা বলেন, “তবু শুধু ভালোবাসা মেলে বলেই আরও শিশু রাখার অনুরোধ আসে।”
আশ্রমকর্তা গৌতমবাবু ও স্বপ্নাদেবীর এখন স্বপ্ন আশ্রমের ছেলেরা বড় হবে। বাড়বে আশ্রম। আর তাতে অনাথ শিশুরা এসে খুঁজে নেবে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া শৈশব। |
|
|
|
|
|