|
|
|
|
প্রতিযোগিতায় বাঁচতে বদলাচ্ছে চিরায়ত তাঁত |
দেবমাল্য বাগচি • খড়্গপুর |
দিন বদলের সঙ্গে পাল্টাচ্ছে মানুষের রুচিবোধ। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে বাংলার চিরন্তন তাঁতের শাড়ি। হাল ফ্যাশনের নিত্য নতুন শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এবার পুজোয় নতুন রূপে বাজারে হাজির তাঁতের শাড়ি। ডিজাইনে বৈচিত্র আর নামের অদল বদলে নতুন মোড়কে পুরোনো তাঁতের শাড়ির ঐতিহ্য আজও ফিকে হয়নি এতটুকু।
মুঘল আমল থেকেই ভারতে তাঁতবস্ত্রের রমরমা। সুতো দিয়ে দু’টি মাকুর উপর নির্ভর করে হাতে বোনা শাড়িই মূলত তাঁতের শাড়ি নামে পরিচিত। সেই সময় অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা থেকেই শুরু হয় ‘মসলিন’ শাড়ি তৈরির কাজ। মখমলের মতো মসলিনের ৫ মিটার শাড়ি একটি আংটির মধ্যে দিয়েও বেরিয়ে যেতে পারে। ক্রমে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সামান্য রেশমের ব্যবহারে সেই কাপড়ই হয়ে ওঠে ঢাকাই, জামদানি। কিন্তু ব্রিটিশদের চাপে ক্রমে বন্ধ হয়ে যায় তাঁতশিল্প। বাংলাভাগের পর হুগলি সহ নদিয়ার শান্তিপুর, ফুলিয়া, বর্ধমানের ধাত্রীগ্রামকে কেন্দ্র করে বাংলার তাঁতশিল্প যেন নতুন জীবন ফিরে পায়। আটপৌরে বাঙালির ঘরে জায়গা করে নেয় ধনেখালি, শান্তিপুরী, ফুলিয়ার তাঁত। তবে এখন মিলের শাড়ি, নতুন ডিজাইনের সিল্কের শাড়ি অনেকটাই বাজার দখল করেছে তাঁতের শাড়ির। সুন্দর ডিজাইনের কারুকাজে শোভিত শাড়ির অফুরন্ত সম্ভার নিয়ে ক্রেতাদের মন জয় করেছে বুটিক শিল্পীরাও। তবে বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁতের শাড়ির আত্মিক বন্ধন। তাই বাজার ধরতে বদলাচ্ছে তাঁতের শাড়িও। চিরাচরিত তাঁতের সঙ্গে অভিনব নকশার সংমিশ্রণে বাজারে এসেছে বাহা, খেইস, তাঁত মটকা, তাঁত ঘিচা শাড়ি। |
|
খড়্গপুর আইআইটিতে তোলা ছবি। —নিজস্ব চিত্র। |
সম্প্রতি খড়্গপুর আইআইটি ক্যাম্পাসের কাজি নজরুল কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল তাঁতবস্ত্রের মেলা ও প্রদর্শনী। মেলায় আসা ফুলিয়ার মালঞ্চপাড়া মহিলা তন্তুবায় সমবায় সমিতির আনন্দগোপাল দত্ত বেশ মজা করেই বলছিলেন, “বাজার ধরতে একই শাড়ি বিভিন্ন নামে আসছে। বাহা শাড়ি বাজারে এনেছিলেন সদ্য প্রয়াত ফুলিয়ার তাঁতি চিরঞ্জিত বসাক। এ দিকে বাংলার মোটা কাপড় এখন নতুন রূপে বাজারে এসেছে খেইস নামে। আবার এই শাড়িটিকেই বুটিক শিল্পীরা আদর করে নাম দিয়েছে মাকু। আরে বাবা মাকু দিয়েই যে তাঁত চলছে সে আর কে বোঝায়।” তাঁর কথাতেই স্পষ্ট, চেনা ছক বদলে যুগের তালে চলছেন তাঁতশিল্পীরাও। তাই এ বার খড়্গপুরের তাঁতবস্ত্র মেলায় পুরনো ডিজাইনের তাঁতের শাড়ির বাজার তেমন জমেনি। বর্ধমানের ধাত্রীগ্রামের ষষ্ঠীতলা হ্যান্ডলুম ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্টলের গৌরাঙ্গ বসাক, কাটোয়া শিল্প সমবায়ের সুবোধ দত্তদের কথায়, “এখানে এ বছর প্রথম এসেছি। ক্রেতারা এখন একটু অন্য রকমের শাড়ি চাইছে। তা আনতে না পারায় বাজার ভাল ধরতে পারছি না। দামি জামদানির দিকেও তেমন ঝোঁক দেখছি না।”
তবে কাঁচামালের চড়া দামের দরুণ তাঁতশিল্প সমস্যার মুখে পড়লেও তাঁতের বাজার যে নষ্ট হয়নি তা স্বীকার করছেন সকলেই। পশ্চিম মেদিনীপুর হস্তচালিত তাঁতবস্ত্র উন্নয়ন আধিকারিক আব্দুল আজিজ মণ্ডল বলেন, “তাঁতের বাজার ভালই রয়েছে। তবে ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে।” তাঁতবস্ত্রের উৎকর্ষতা ধরে রাখতে সোনার হলমার্কের মতোই সমবায়গুলিকে সরকারি ‘লোগো’ দেওয়া হয়েছে। সেগুলি ব্যবহারে কড়া নজরও রাখছে সরকার। ভারত সরকারের টেক্সটাইল মন্ত্রকের এক কোষাধ্যক্ষ সজল কুণ্ডু বলেন, “আমরা মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন মেলার স্টলগুলিতে গিয়ে লোগো ব্যবহার হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখি। প্রতি বছর বিভিন্ন সমবায়ে তাঁতের সংখ্যা অনুযায়ী লোগো বন্টন করা হয়। অনেকক্ষেত্রে সমবায়গুলি তা না মানলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।”
রূপ বদলে হাল ফ্যাশনের শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাঁতও যে জোরকদমে এগোচ্ছে তা বলাই যায়। |
|
|
|
|
|