প্রবন্ধ ২...
কানাগলিতে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় এলাম
৯৬০ সালে আমেরিকায় এক জাতিদাঙ্গার প্রেক্ষিতে রিচার্ড নিক্সন মন্তব্য করেছিলেন, “হিংসাত্মক সংঘর্ষ এবং দাঙ্গার মধ্যে মূল ফারাক হল, প্রথমটি স্বতঃস্ফূর্ত, দ্বিতীয়তটি পরিকল্পিত।” ভারতের আজকের রাজনীতি দেখলে রিচার্ড নিক্সন নিশ্চয় তাঁর মন্তব্য সংশোধন করতেন। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছেন, ওই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ পূর্বপরিকল্পিত। যুদ্ধের জন্য যে ভাবে পরিকল্পনা করা হয় ঠিক সেই ভাবে সমস্যা নির্মাণ করে আসলে এটি নির্বাচনী সমাধানের রাস্তা তৈরির চেষ্টা। মুলায়ম সিংহ যাদবের দল না বিজেপি, কে আগে এই সংঘর্ষ শুরু করেছে সে বিতর্কের ঠিক জবাব যা-ই হোক না কেন, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই যে দু’পক্ষই উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনৈতিক মুনাফা তুলতে চাইছে। নরেন্দ্র মোদীর নাম প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। মোদীর নেতৃত্বের ছবি দেখিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারবে কি না সেটা এই আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু গোধরার কলঙ্ককে ব্যবহার করে বিজেপি এবং তার প্রতিপক্ষ দলগুলি সকলেই যদি এই মেরুকরণের সুযোগ নিয়ে দেশকে সাম্প্রদায়িকতার পথে আরও ঠেলে দেয়, তা কিন্তু হবে বিপজ্জনক।
হিন্দু ধর্ম একটি একস্তরীয় জাতিসত্তা নয়। তার মধ্যে আছে নানান বৈচিত্র নানা ধরনের জাত, নানা ধরনের ধর্মীয় লোকাচার ও সংস্কৃতি, এমনকী নানা ধরনের আঞ্চলিক এলাকাভিত্তিক ভিন্নতা। সংঘ পরিবার যদি হিন্দুত্বকে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় সত্তা হিসাবে তুলে ধরতে চায়, একটি গোষ্ঠী সত্তা হিসাবে ভোটের অঙ্কে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে চায় তবে বহুত্ববাদী এই ভারতের নাগরিক হিসাবে শঙ্কা হয়।
অতীত? দাঙ্গাবিধ্বস্ত মুম্বই। ১৯৪৬
বস্তুত, আশঙ্কাটা গভীরতর। ভারতীয় মহাজাতির অখণ্ড সত্তার সুসংহত ভূমিকাকে গ্রহণ না করে আলাদা আলাদা করে পৃথক পৃথক সত্তা ‘কাট অ্যন্ড পেস্ট’ করার রাজনীতিই ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠেছে। সত্তার বহুস্তরীয় সংমিশ্রণ নয়, তার বদলে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী-সত্তার পৃথক পৃথক মনিহারি দোকান। এই খণ্ডগুলির যান্ত্রিক সংযুক্তি হতে পারে, কিন্তু সুসংহত অখণ্ড জাতিসত্তার সামগ্রিক উন্নয়নবার্তা তাতে থাকে না। সমাজবিজ্ঞানী এরিক ফ্রম ফিয়ার অব ফ্রিডম বইতে বলেছিলেন, প্রবল অনিশ্চয়তায় মধ্যে ব্যক্তিমানুষ কোনও একটি ধর্মীয় বা ওই জাতীয় কোনও গোষ্ঠীর মধ্যে নিজের সত্তাকে নিমজ্জিত করে। তাতে ওই গোষ্ঠীও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তার ভিতরে ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করে অন্য গোষ্ঠী-সত্তাকে অস্বীকার করে। তার উপরে আঘাত হানে। গোষ্ঠী-চেতনা সক্রিয় হয়ে ফ্যাসিবাদের পথ প্রশস্ত করে। আর এখানেই অবতীর্ণ হন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, বহুমাত্রিক সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার না করে আমার সত্তার স্টিমরোলার দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চাই তোমাকে। এই পরমত-অসহিষ্ণুতা যে আমরা-ওরার জন্ম দেয়, সেই অদৃশ্য হিংসাই অনেক সময় দাঙ্গার দগদগে ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে।
এমন একটা অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জীবনে জীবন যোগ না করে যান্ত্রিক ভাবে নানা গোষ্ঠীর জন্য নানা ভাবে ‘ধর্মমোহ’ তৈরি করাই রাজনেতাদের অভীষ্ট হয়ে ওঠে। মুলায়ম সিংহ যাদব উত্তরপ্রদেশের মুসলমান সমাজের সামনে মোল্লা-মুলায়ম সেজে বলতে চাইছেন, তুমি গরিব না ধনী, সেটা বিচার্য বিষয় নয়, আসল কথা হল তুমি মুসলমান। এই গোষ্ঠী-সত্তার বোধ জাতপাতের চেয়েও তীব্র এক অনুভূতি। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের সময় দেখেছিলাম, মণ্ডল বমান কমণ্ডলুর লড়াই। তখন জাতপাতভিত্তিক সংরক্ষণের অ্যান্টিথিসিস হিসাবে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের সত্তাকেও একটি স্বকীয় পৃথক সত্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। পরে অবশ্য ভারতীয় রাজনীতির মণ্ডলায়নের প্রভাব বিজেপিতেও এসে আছড়ে পড়ে। আজ সংঘ পরিবার হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণের পাশাপাশি দলিত-নিম্নবর্গকেও সঙ্গে পেতে চায়, যাতে সুসংহত ভোটব্যাঙ্ক তার কবজায় আসে।
দুই গোষ্ঠীর কট্টরপন্থীরা তাঁদের মেরুকরণের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে একে অন্যের শক্তিবৃদ্ধি করেছেন, এর দৃষ্টান্ত নতুন নয়। অতীতেও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিতে পরস্পরের বিরোধী দুই শক্তি ভারতীয় রাজনীতিতে একে অন্যের পরিপূরক থেকেছে। আজও সেই ট্র্যাডিশন চলেছে। মরিয়া মুলায়ম সংখ্যালঘু ভোট করায়ত্ত করতে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধিতেও আতঙ্কিত নন। আবার উগ্র হিন্দু নেতারা অনেকে মনে করেন, ‘সীমিত দাঙ্গা’ ভোটের স্বার্থে মন্দ নয়। হিন্দু সত্তার নিরাপত্তার অভাববোধ যত বাড়বে, বিজেপির আসন সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। এন ডি এ নামক জোট রাজনীতির স্বার্থে হিন্দুত্বকে অনেকটাই সংযত রাখতে হয়। তাতে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক থমকে রয়েছে। হিন্দুত্বে গতি আনতে হবে।
ব্রিটিশ যুগে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার জন্য আমরা ঔপনিবেশিক শাসকদের ভেদনীতিকেই দায়ী করেছিলাম। ভেবেছিলাম, ভেদনীতির জনক ইংরেজ শাসন অপসৃত হলেই আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করব। স্বাধীনতার ছয় দশক পরে আজ আর সেই স্বপ্নের স্মৃতিচারণার কোনও অবকাশ নেই। মুজফ্ফরনগর তো বিন্দুতে সিন্ধু। আধুনিক নব্য প্রজন্মের প্রতিনিধি ইংরাজি শিক্ষায় সুশিক্ষিত অখিলেশ যাদবের ক্ষমতাসীন হওয়ার দেড় বছরের মধ্যেই ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্যে অর্ধশত দাঙ্গা। এক দিকে প্রযুক্তি-শিল্পায়ন-উন্নয়ন-অ্যাপ্ল-সোশ্যাল মিডিয়া, অন্য দিকে ক্ষুদ্র সংকীর্ণ সত্তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পাটিগণিত।
এই অঙ্ক হঠাৎ আসেনি। দীর্ঘ দিন ধরে আমরা ভারতীয় রাজনীতিতে জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষের সত্তাকে ভাগ করতে চেয়েছি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গাঁধী ও নেহরুর মতাদর্শের ভিত্তিতে নানান সত্তার অ্যাসর্টেড চকোলেটের মতো একটা বৃহৎ মণ্ড তৈরি করতে চেয়েছিল, কিন্তু কংগ্রেসের অবক্ষয়ের পরিণাম হিসাবে দেশের নানা প্রান্তের নানা দল নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্তার ইজারা নিয়ে নতুন নতুন দল গঠন করে। কেউ দলিত সত্তার অভিভাবক হয়, কেউ যাদব সমাজের। পরবর্তী কালে দেখা গেল, শুধু জাতপাত বা ভাষাগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংঘাত নয়, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিও এক একটি পৃথক সত্তার খুচরো ও পাইকারি বিক্রেতায় পরিণত হতে চাইল এই গ্রেট ইন্ডিয়ার উপভোক্তা সমাজে। ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান কথাটার এক নতুন অর্থ খুঁজে নিলাম আমরা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের সমস্যাটা বিশেষ ভাবে বিচার্য। ১৯৫৭’র সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম ভোট কংগ্রেসের পক্ষে থাকলেও ’৬৭ সালে সেই মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন দেখা যায়। যুক্তফ্রন্টের ব্যর্থতার জন্য ’৭১ সালে আবার কংগ্রেস মুসলমান ভোটব্যাঙ্ককে নির্বাচনী স্বার্থে কাজে লাগায়। কিন্তু ’৭৭ সালে জনতা পার্টি দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম সৈয়দ আবদুল্লা বুখারিকে নির্বাচনী রাজনীতির ময়দানে নামিয়ে দেয়।
আসলে কংগ্রেসের সমস্যা হল, মতাদর্শগত ভাবে কংগ্রেস কোনও দিনই কোনও খণ্ডিত সত্তার স্বার্থরক্ষার জন্য কোটা-ভিত্তিক রাজনীতি করতে চায়নি। কিন্তু যখন ইন্দিরা ভেবেছিলেন শুধু মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের উপর ভরসা রাখা যাচ্ছে না তখন, ১৯৭৬ সালে, সঞ্জয় গাঁধী দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে যৌথ সমাবেশ করে হিন্দি বলয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিলেন। রাজীব গাঁধীও কখনও সংখ্যালঘু কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের জন্য পেন্ডুলামের মতো এক বার এ দিক এক বার ও দিক দোদুল্যমান থেকেছেন। ফলে অযোধ্যার শিলান্যাস ও শাহবানু মামলা আখেরে লোকসানই হয়েছে রাজীব গাঁধীর।
উত্তরপ্রদেশের দাঙ্গা আজ আবার আমাদের এক নতুন রাস্তার মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনে কেউ জিতবে, কেউ হারবে। এটাই দস্তুর। কিন্তু সত্তার স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার রাজনীতির জন্য এক ভয়াবহ দাঙ্গার অন্ধগলিতে হেঁটে যাওয়ার আশঙ্কায় বড় বিষাদগ্রস্ত আমরা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.