সম্পাদক সমীপেষু...
বিজ্ঞান অন্য বস্তু
সুস্নাত চৌধুরী (‘কে সি পাল’, রবিবাসরীয়, ১৮-৮) ঠিকই লিখেছেন, অন্তত ডেডিকেশন আর টেনাসিটির প্রশ্নে কে সি পাল আমাদের ইতিহাসের অতিমানবিক চরিত্রগুলির সঙ্গে তুলনীয়। প্রসঙ্গত, তিনি আমতার আনুলিয়া গ্রামের যে বি আর এ ইউনাইটেড হাইস্কুলের (এ আর বি হাইস্কুল নয়) প্রাক্তন ছাত্র আমি সেই স্কুলেরই বর্তমান ভূগোল শিক্ষক। বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। আমি ক্লাসে পৃথিবীর আবর্তন ও পরিক্রমণ পড়াচ্ছি। এমন সময় এক বয়স্ক মানুষ (পরে জেনেছিলাম তিনিই কে সি পাল) ক্লাসে প্রবেশ করে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘মাস্টারমশাই, আপনি কেন ছাত্রদের ভুল পড়াচ্ছেন? আমি প্রমাণ করে দেব সূর্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে’। প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলাম। অ্যাকাডেমিক বিতর্ককে শ্রদ্ধা করি। আমি ওঁর চ্যালেঞ্জের উত্তরে বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনি চক, ডাস্টার, গ্লোব নিয়ে ছাত্রদের সামনেই প্রমাণ করুন যে, সূর্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘোরে’।
উত্তরে উনি যেটা বললেন, তাতে পৃথিবীর চার দিকে সূর্য ঘুরছে ধরে নিলে ঋতু পরিবর্তন এবং দিন রাত্রি সংগঠিত হওয়ার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না সূর্য পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে। এর পর যখন আমি ওঁকে হাইপোথেটিক্যাল বা পরোক্ষ প্রমাণ নয়, সরাসরি নাসার ওয়েবসাইট থেকে উপগ্রহ মারফত পাঠানো পৃথিবীর পরিক্রমণের চিত্র দেখাতে চাইলাম, তা উনি দেখতে রাজি হলেন না। ক্লাসে ছাত্রদের মধ্যে হাস্য কোলাহল সৃষ্টি হলে উনি চলে গেলেন।
নিজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য কে সি পালের অক্লান্ত প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। কিন্তু বিজ্ঞানীর কাজ বিরোধী যুক্তি খণ্ডন করেই নিজের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করা। তবে আমেরিকার স্কুল পাঠ্যবইতে (চার্চকে খুশি করার জন্য!) ঠিক তথ্যটির পাশে পৃথিবীর চার দিকে সূর্যের পরিক্রমণের তত্ত্বটি যে অনেক মানুষের বিশ্বাস তার উল্লেখ থাকে।
কী আর করতে পারি
ফুকার মুর্মু, ঝান টুডু, মাধ মান্ডি, হিরো মাহাতো, দশই হেমব্রম স্কুলে ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসের পড়ুয়া। শিক্ষার্থী হিসেবে এরা একটু অন্য ধরনের। মুখে কোনও কথা নেই। ভাবলেশহীন চোখমুখ। মজার কথাতেও প্রতিক্রিয়াহীন। পড়া জিজ্ঞাসায় মুখে কুলুপ আঁটা। পড়ানোর ফাঁকে, বোর্ডওয়ার্কের অবসরে যখন চোখ পড়ে ওদের উপর, দেখি শূন্য দৃষ্টিতে ওরা জরিপ করে চলেছে আমার পড়ানোর ভঙ্গিমাকে। নীরব স্ট্যাচু জেনেও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি, কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ানো আর হাতের ইশারায় বসে পড়া দেখতে দেখতে ক্লান্ত হই। ওদের সার সার স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে পড়াটা আমার কাছেই অনন্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। খুব মনে পড়ে আমার পুরনো স্কুলের এক ছাত্রীর কথা। পড়া জিজ্ঞাসার উত্তরে সে বলেছিল, ‘কাল রাতের বেলায় বাবা মদ খেয়ে মাকে মারল। মা রেগে হ্যারিকেনটা ভেঙে দিল। আমি কী করে পড়া করব?’ তার সে দিনের সেই ঝাঁঝালো পালটা প্রশ্নের মুখে, বেবাক আমি বেজায় অস্বস্তিতে পড়ি। তাই আজও এই সার সার শূন্য দৃষ্টির বিপরীতে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। নিজের মনকে শান্ত প্রশমিত মনকে করতে প্রবোধ দিই, ‘আমি তো আমার কাজ করছি, আর কী করতে পারি।’ সাময়িক আরাম মেলে। পরের দিন আবার সেই হুবহু আগের দিন। দারিদ্র আর অপুষ্টির গন্ধে ভরে থাকে ক্লাসরুম। ওদের ব্যাগে বইপত্রে কাঠ-কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ। বোতামহীন শার্টে একাধিক সেফটিপিন। মলিন মুখের ছাত্রীদের রুখু মাথায় সস্তার লাল ফিতে।
এরই মাঝে এসে দাঁড়ায় ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। ড. রাধাকৃষ্ণন-এর বাঁধানো ছবি দেওয়াল থেকে নামিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। দু’কলি গান, কয়েকটা কবিতা, খানিকটা বক্তিমে (যেখানে রাধাকৃষ্ণন হয়ে যান রাধাকৃষ্ণ) দিয়ে শেষ হয়। মলিন মুখের ছাত্রছাত্রীরা চাঁদা তুলে শিক্ষকদের হাতে তুলে দেয় যথাসাধ্য উপহার। পা ছুঁয়ে প্রণাম। ছুটি।
পরের দিন থেকে আবার সেই সার সার ভাবলেশহীন মুখ, ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগ, সেফটিপিন লাগানো জামা, পড়া শোনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ শূন্যদৃষ্টি। দেওয়ালে ড. রাধাকৃষ্ণন-এর ছবিতে বাসী ফুলের শুকনো মালা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.