প্রবন্ধ ১...
‘অতীত ভুলে যাও’ বা ‘তবু মনে রেখো’
পূর্বনারী ও পূর্বপুরুষদের মনে রেখো, ভুলে যেয়ো না প্রতি বছর পিতৃপক্ষ আমাদের এই কথা স্মরণ করায়। কিন্তু স্মৃতি-বিস্মৃতির ঈপ্সিত অতীত আছে কোথায়? ‘অতীত ভুলে যাও’ অথবা ‘তবু মনে রেখো’, এই জাতীয় আদেশ অনুরোধের কি কোনও মানে হয়? এমন অনেক কাজ আছে যা আমরা অন্যদের করতে অনুরোধ বা আদেশ করি, যে কাজ চেষ্টা করে করা যায় না। অথচ যুক্তিবুদ্ধি বলে, যা এক জনের প্রয়াসসাধ্য নয়, যেমন নিজের পিছনে গিয়ে দাঁড়ানো, তেমন কাজ তাকে করতে বলাটাই বাতুলতা। আমরা যেমন অসুস্থ রুগিকে দেখতে গিয়ে বলি, ‘তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো’। এটা কি একটা আদেশ করবার মতো কথা হল? আচ্ছা, সেটা না-হয় ঈশ্বরবিশ্বাসী বক্তা হলে পরে ‘প্রার্থনা করি, তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো’, তারই একটা সংক্ষিপ্ত আকার। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন রাতে কিশোরকিশোরী সন্তানকে অনেক বাবা-মা বলে থাকেন বেশি রাত জেগে বইয়ে (অথবা ফেস বুকে) মুখ গুঁজে থাকলে ‘এ বার ঘুমিয়ে পড়ো’। অথচ ঘুমিয়ে পড়বার চেষ্টা করা মানেই ঘুমোতে না-পারা। চেষ্টা করে জেগে থাকা হয়তো যায় অনেক সময়েই, কিন্তু চেষ্টা করে ঘুমোনো যায় না। যদি-না এই ‘ঘুমিয়ে পড়ো’ কথার মানে হয় ‘ঘুমের ওষুধ খাও’। সম্ভবত অবিশ্বাসীকে ‘বিশ্বাস করো’ এবং প্রেমহীন ব্যক্তিকে ‘ভালবাসো’ বলাটাও এ জাতীয় অসম্ভব উপরোধ। ঠিক এ রকমই এক অসম্ভব অনুরোধ বা আজ্ঞা হল: ‘ভুলে যাও।’ যে কথাটা ভুলতে বলা হচ্ছে, সেটা এই অনুজ্ঞার মধ্যে ঢোকানো থাকেই। তা নইলে সাধারণ ভাবে (যা-হোক একটা কিছু) ভুলে যেতে তো আর বলা হচ্ছে না! কিছু-না-কিছু তো আমরা ভুলছিই সারাক্ষণ। কিন্তু বিশেষ করে ‘আমি যে গত সপ্তাহে তোমাকে অকারণে কটু কথা বলেছিলাম, সেটাও ভুলে যাও’, এই কথাটা যাকে বলা হচ্ছে, তাকে তো উল্টে নুনের ছিটে দিয়ে মনে করিয়েই দেওয়া হচ্ছে কী ভুলতে হবে। পরের দিন যদি যাচাই করে দেখতে হয়, সে ঠিক ঠিক আদেশ পালন করেছে কি না, তা হলে জিজ্ঞেস করলে চলবে না, ‘ওই কথাটা ভুলে গেছ তো?’ কারণ যদি সত্যিই শ্রোতা ভুলে গিয়ে থাকে, সে বলবে ‘কোন কথাটা? মনে নেই তো কী যেন ভোলবার কথা ছিল?’ চেষ্টা করে ভোলা অসম্ভব। বিস্মৃতি, নিদ্রার মতনই, অনায়াসে আসে। তাকে আনতে আয়াস করলেই সে বেঁকে বসে। যত ভুলতে চাই তত বেশি করে মনে পড়ে কোনও বেদনা, অত্যাচার, অপমান, যন্ত্রণা অথবা এখন বেদনা-হয়ে-যাওয়া সুখের স্মৃতি।
অবিস্মরণ। ৯/১১-র এক যুগ পরে। নিউ ইয়র্ক, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩। ছবি: এ এফ পি
তা হলে ভুলে যাওয়াটা কি একটা স্বেচ্ছাধীন কাজই নয়? গায়ে ঘামাচি ওঠার মতন ওটা কি আমাদের মস্তিষ্কে হয়, কিন্তু আমরা করি না? এ নিয়ে হলিউডের ছবি হয়েছিল একখানা। অবাঞ্ছিত অতীতস্মৃতি গ্যারান্টি দিয়ে মাথা থেকে মুছে দেবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে দোকান খুলেছিল কোনও আধো-খ্যাপা আধো-বদমাইশ স্নায়ুচিকিৎসক। কেট্ উইনস্লেট যে নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সে এক যন্ত্রণার স্মৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্মৃতি ধুয়ে ফেলতে তার কাছে গিয়েছিলেন। তার পর ঠিক কী হল তা আমি চেষ্টা করেও এখন মনে করতে পারছি না। কিন্তু আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই অতীতে এমন অনেক ঘটনা থাকে, যা আমরা ভুলতে চাই, কিন্তু পারি না। শংকরাচার্যের নামে চলে এমন একটি সুন্দর ‘নৈতিক’ স্তোত্র আছে। তার নাম ‘প্রশ্নোত্তরমালিকা’। তাতে আছে ‘আমরণাৎ কিং শেলম্? রহসি কৃতং দুষ্কৃতম্’। ‘মৃত্যু পর্যন্ত শেলের মতো বিঁধে থাকে কোন জিনিস?’ ‘গোপনে করা খারাপ কাজ’। হয়তো কেউ কোনও দিন জানবে না। কিন্তু তবু নিজে ভুলতে পারি না। তাই কোনও অনুশোচনার মলমেও ওই পীড়া সারে না।
কিন্তু ধরা থাক কোনও অবস্থায় সত্যিই ওই কুকার্যের স্মৃতি আমার মন থেকে চিরতরে মুছে গেল। ট্যাক্সিচালককে তাড়া দিয়েছিলাম শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার কালে। রাস্তায় ওভারটেক করতে গিয়ে বুড়ো গৃহহারা ভিখিরিকে ধাক্কা দিয়ে আহত (না কি নিহত? কোনও দিন জানা যাবে না) অবস্থায় পথশায়ী করে চলে গিয়েছিলাম। ধরা যাক ঘটনাটা ট্যাক্সিচালকের মনে নেই, আমার মনে নেই। বুড়োটি মৃত। ঘটনাটার কোনও চিহ্ন কারও সজ্ঞান বা অজ্ঞান উদ্ধারণীয় স্মৃতিতে কোথাও নেই। কোনও নথি নেই, কোনও কার্য থেকে কারণে ফিরে যাওয়ার মতো ‘শেষবৎ অনুমান’-এর লিঙ্গ বা হেতু বা ‘ক্লু’ নেই কোথাও। প্রশ্ন হল, এই অতীত ঘটনাটি যে ‘সত্য’, অর্থাৎ ‘একটি দ্রুতগামী ট্যাক্সি অমুক তারিখ সকালে এক বুড়ো ভিখিরিকে ধাক্কা দিয়ে ধরাশায়ী করে পিছনে ফিরে না তাকিয়ে ঝড়ের বেগে পালিয়েছিল’, এই বাক্যকে যা সত্যতা দিচ্ছে, সেই ঘটনাটির বাস্তবতা কোথায়?
‘কোথায়’ কথাটা আর একটু ধীরে সুস্থে ভাঙা যাক। সাধারণ ভাবে আমরা ধরেই নিই যে, কোনও বস্তু থাকলে, কোনও ঘটনা ঘটলে তা কোনও জায়গাতে থাকবে অথবা ঘটবে। কোনও কালে, কোনও দেশে যা নেই, তা নেই-ই। শুধু কালে হলে চলবে না, দেশে এবং কালে। বিশ শতকের গভীরতম বিশ্লেষণী সত্তা-দার্শনিক পিটার স্ট্রসন্ সূক্ষ্ম যুক্তি প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন, স্থানহীন মাত্র কালাত্মক একটা জগৎ তৈরি করার ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’ (‘ভেবে দেখি তো পারি কি না’ জাতীয় কল্পনাপরীক্ষণ) শেষ পর্যন্ত অন্তর্বিরোধে জর্জরিত হয়ে বিফল হতে বাধ্য। থাকতে গেলে, ঘটতে গেলে কোনও স্থানেই থাকতে বা ঘটতে হবে। কিন্তু নথিহীন, স্মৃতিহীন, হেতুহীন, নিশ্চিহ্ন, অবসিত অতীত কোন স্থানে আছে? অতীতের কোনও কোনও ঘটনাকে যে আমরা মনে রাখতে চাই, আর কোনও কোনও ঘটনাকে যে ভুলে যেতে চাই, এই স্মরণচেষ্টা আর বিস্মরণপ্রয়াসের বিষয়বস্তুই তো অলীক বলে মনে হচ্ছে। কাকে ভুলতে বলছি? কাকে ভুলতে চাইছি না? কোথাও না থাকলে তারা জ্ঞান-অজ্ঞানের বিষয় হবে কী করে?
হাজার হাজার বছর আগে যে শ্রমিকরা ঘাড়ে করে পাথর বয়ে মিশরের পিরামিড বা স্ফিংক্সের প্রকাণ্ড প্রতিমূর্তি বানিয়েছিলেন তাঁদের অস্তিত্ব আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু এখন কোথাও নেই বলেই তাঁরা ‘অলীক’ বা কল্পিত তো হতে পারেন না। পিরামিড যদি বাস্তব হয়, পিরামিড নির্মাতারাও বাস্তব। কিন্তু গভীর সমস্যা হচ্ছে বাস্তব অস্তিত্ব আর বর্তমান অস্তিত্বের মধ্যে সম্বন্ধ নিয়ে। কেবল যা ইদানীং আছে, তা-ই বাস্তবিক আছে এ কথা কেউই তর্কের খাতিরে ছাড়া ভাবতে পারেন না। আমার বাবা-ঠাকুরদা ইদানীং নেই বলে তাঁরা যদি আলাদীনের প্রদীপদৈত্যের (যাকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বোধহয় ‘প্রদীপ দত্ত’ নাম দিয়েছিলেন) মতন কল্পিত হন, তা হলে আমার জন্ম একটা কল্পকাহিনির অলীক চরিত্র থেকে হয়েছে বলে স্বীকার করতে হয়! কাজেই অতীত (বর্তমানে ধ্বংসাভাবের দ্বারা কবলিত টেকনিক্যাল ভাষায় ‘ধ্বংসাভাবপ্রতিযোগী’) সদ্বস্তুগুলি ইদানীং না থাকলেও ত্রিকালনিরপেক্ষ অর্থে আছে। এই যুক্তি ছাড়াও বাস্তবসত্তাকে বর্তমান বা ‘এই সময়’-এর মধ্যে সংকুচিত করে আনলে এই সংকোচনের সীমারেখা কোথায় টানা হবে, সেটা বলা শুধু শক্ত নয়, এক রকমের অসম্ভব। যদি মিশরের সেই অনাম্নী অঙ্গনারা, যাঁরা মহারানি ক্লিয়োপেট্রার স্নানের জন্য সুগন্ধি জলের ব্যবস্থা করতেন, তাঁরা অ-বর্তমান হন, তা হলে গতকাল রাতে যে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটাও অতীত এবং অ-বর্তমান। গত ঘণ্টা বা বিগত মিনিটে যে ছোট ঘটনাটা ঘটেছে, সেটাও তো তবে সক্রেটিসের বিষ পানের মতনই অতীতের গর্ভে চলে গেছে। বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছিলেন, লজিকের দিক থেকে (যদি কেউ অতীতমাত্রকেই অবাস্তব মনে করেন) ব্রহ্মাণ্ডটা এই মুহূর্তে জন্মাল, বিশ্বের ইতিহাসের ‘প্রথম-আদি’ ক্ষণে এখুনি আমরা বাস করছি, এই রকম আজগুবি প্রকল্পকেও কাটবার মতন কোনও যুক্তি পাওয়া যায় না। কিন্তু যেহেতু গত রাতের ভালমন্দ সব ঘটনাই শুধু বাস্তব নয়, অপরিবর্তনীয় ভাবে (মনে থাকুক বা না থাকুক) বাস্তব, সেহেতু বাস্তবতা বলতে আমরা শুধু বর্তমানতাকে বুঝতে পারি না। বাস্তবতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হল নিশ্চয়তার। অতীত ইতিহাস দস্তাবেজ অথবা স্মৃতির মাধ্যমে যতই অনিশ্চয়তার কুয়াশা কাটিয়ে আসুক, তার বাস্তবতার দাবি থাকে বলেই বোধহয় ইংরেজিতে নিশ্চয়তার দৃঢ়তা বোঝানোর জন্য আমরা বলি, ‘ডেড শিয়োর’। অতীত মৃত বলেই নিশ্চিত! অপরিবর্তনীয়!
(চলবে)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই মানোয়া’য় দর্শনের অধ্যাপক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.