গুন্ডার মতো আচরণ মন্ত্রীদের: কোর্ট
রাস্তা আটকে পুজো, তোপ পুলিশকেও
পুজোর নামে রাস্তা বন্ধ করে রাজ্যের কিছু মন্ত্রী গুন্ডার মতো আচরণ করছেন বলে মন্তব্য করল কলকাতা হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আদালতের পর্যবেক্ষণ, এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের তরফে নিয়ম-কানুন প্রয়োগের কোনও বালাই থাকছে না!
যৌনকর্মী সংগঠনের দায়ের করা এক মামলার শুনানিতে মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্যটি করেছেন, পর্যবেক্ষণটিও তাঁর। বিচারপতির মতে, পুজোর অনুমতিদানে প্রশাসন দ্বিচারিতা করছে। “পুজোর সংগঠকেরা নেতা-মন্ত্রীর মতো প্রভাবশালী হলে প্রশাসনের মনোভাব এক রকম, বাকিদের ক্ষেত্রে অন্য রকম।” আক্ষেপ করেছেন বিচারপতি। এবং এ ব্যাপারে সরকারি কৌঁসুলির কাছে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না-পেয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের রিপোর্ট তলব করেছেন তিনি। কী কী নিয়ম মেনে রাস্তায় বারোয়ারি পুজো আয়োজনের অনুমোদন দেওয়া হয়, রিপোর্টে তার উল্লেখ থাকতে হবে।
আদালতের মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণ কোনওটির সঙ্গেই অবশ্য রাজ্য সরকার একমত নয়। প্রশাসনের শীর্ষ মহলের দাবি, শহরে যত সর্বজনীন দুর্গাপুজো, সবগুলিই আয়োজিত হচ্ছে যথাবিহিত নিয়ম-নীতি মেনে। এমনকী, মণ্ডপ নির্মাণ ইত্যাদির প্রশ্নে আদালতের পূর্ববর্তী নির্দেশিকাও যথাযথ ভাবে পালন করা হচ্ছে। নতুন কোনও পুজোর অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না। এর প্রেক্ষাপটে প্রশাসন-সূত্রের বক্তব্য: এই মুহূর্তে এমন কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি, যাতে বিষয়টি নতুন করে উঠে আসতে পারে। বস্তুত এ দিন হাইকোর্টে শুনানির পরে আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারের মনোভাব যাতে যথাস্থানে ঠিকঠাক পেশ করা হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে মহাকরণ-সূত্রের খবর।
হাইকোর্টের এ হেন মন্তব্য-পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতটা কী?
অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট ও মসজিদবাড়ি লেনের মোড়ের এই জায়গায় পুজো করতে
চেয়েছেন যৌনকর্মীরা। পুলিশ অনুমতি না দেওয়ায় মামলা হয়েছে।—নিজস্ব চিত্র।
যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘দুর্বার মহিলা সমিতি’ এ বার উত্তর কলকাতার অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট ও মসজিদবাড়ি লেনের মোড়ে দুর্গাপুজো আয়োজনের অনুমতি চেয়ে বড়তলা থানায় আবেদন করেছিল। তারা জানিয়েছিল, এ জন্য দেড়শো বর্গফুট জায়গা দরকার। পুলিশ অনুমতি না-দেওয়ায় সমিতি হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়। পুলিশের যুক্তি, ওই তল্লাটে পুজো হলে মণ্ডপ ঘিরে স্থানীয় হাজার ত্রিশেক যৌনকর্মী ও তাঁদের লোকজনের ভিড় জমবে। তাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তো জটিল হয়ে উঠবেই, ঘোর যানজটও দেখা দেবে বলে পুলিশকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
পুলিশি যুক্তির বিরোধিতা করে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ দিন একটি গণেশপুজোর ছবি দেখান দুর্বারের কৌঁসুলি অরুণাভ ঘোষ। তাতে দেখা যাচ্ছে, অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট-মসজিদবাড়ি লেনের মোড়ে ঠিক একই জায়গায় একটি গণেশপুজো হয়েছে। অরুণাভবাবু আদালতের কাছে জানতে চান, একই জায়গায় মণ্ডপ গড়ে যদি গণেশপুজো করা যায়, তা হলে দুর্গাপুজো করতে বাধা কোথায়? “দুর্গাপুজোয় যৌনকর্মীরা ব্রাত্য। তাই ওঁরা নিজেরা পুজো করতে চেয়েছেন, সব নিয়ম-কানুন মেনে। কিন্তু যৌনকর্মী বলেই পুলিশ ওঁদের অনুমতি দিচ্ছে না। অথচ প্রভাবশালী উদ্যোক্তারা প্রভাব খাটিয়ে সেখানেই গণেশপুজো করেছে!” অভিযোগ করেন অরুণাভবাবু। তাঁর দাবি, “এতেই স্পষ্ট যে, পুলিশ বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।” বাদীপক্ষের সওয়াল শুনে বিচারপতি সরকারি কৌঁসুলির কাছে জানতে চান, ওই গণেশপুজোর অনুমতি কী ভাবে দেওয়া হল?
সরকারি কৌঁসুলি (গভর্নমেন্ট প্লিডার, সংক্ষেপে জিপি) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বড়তলা থানা অনুমতি দেয়নি। অবৈধ ভাবে পুজো করার জন্য উদোক্তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি।”
বিচারপতি: কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
জিপি: বড়তলা থানায় এফআইআর করা হয়েছে।
বিচারপতি: মাননীয় গভর্নমেন্ট প্লিডার, আমার খুব, খুব ভাল লাগত যদি আপনি বলতেন, বেআইনি মণ্ডপটি পুলিশ ভেঙে দিয়েছে।
জিপি নিরুত্তর। বিচারপতি বলেন, “মনে হচ্ছে, যাঁদের প্রভাব কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম খাটে না। অন্যত্র আবার পুলিশের ব্যবহার ভিন্ন!” সেই সঙ্গে বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, “এ রাজ্যে এখন রাজনৈতিক রং দেখেই পুজোর অনুমতি মিলছে! ব্যবসায়ীরা চেয়েছেন, তা-ই গণেশপুজো করতে দিয়েছে পুলিশ। এ দিকে দুর্বল শ্রেণির মানুষ সে সুযোগ পাচ্ছেন না।”
জিপি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি বলছেন, আবেদনকারীদের দুর্গাপুজোর অনুমতি দিলে যানজট হবে! এ বার বলুন, কলকাতা শহরে রাস্তা বন্ধ করে যে সব পুজো হয়, সেখানে যানজট হয় কি না। এ শহরে তো বেশ কিছু দিন আগে থেকে রাস্তা আটকে মণ্ডপ বানানো হয়। বহু দিন রাস্তা আটকে থাকে!”
সরকারি কৌঁসুলির মুখে জবাব না-পেয়ে বিচারপতি এ বার নিজেই গড়িয়াহাটের একডালিয়া এভারগ্রিনের প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, “রাজ্যের এক মন্ত্রী ওই পুজোয় যুক্ত বলেই কি পুলিশ নিষ্ক্রিয়? ওখানে দীর্ঘ দিন রাস্তা আটকে রাখা হয়। প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে কি?” সদুত্তর না-পেয়ে তাঁর মন্তব্য, “দেখা যাচ্ছে, রাস্তা আটকে পুজো করতে গিয়ে কয়েক জন মন্ত্রী গুন্ডার মতো আচরণ করছেন! তাঁদের জন্য কোনও নিয়ম-নীতি নেই!”
একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজোর সঙ্গে যে মন্ত্রীর নাম জড়িত, তিনি পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বিচারপতির মন্তব্য প্রসঙ্গে যাঁর প্রতিক্রিয়া, “এই পুজো এলাকার মানুষের মনোভাব ও ভাবাবেগকে মর্যাদা দেয়।” সুব্রতবাবুর দাবি, সত্তর বছরের পুরনো ওই পুজোয় কখনওই রাস্তা আটকানো হয়নি। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বা আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের মতো আরও যাঁরা বিভিন্ন পুজোর সংগঠক, বিচারপতির অভিমত তাঁরাও মানতে চাননি।
এ দিন আদালতে বিচারপতির মন্তব্যের পরে জিপি অশোকবাবু অবশ্য নির্বাকই ছিলেন। বিচারপতি তখন জানতে চান, রাস্তায় বারোয়ারি পুজো আয়োজনের অনুমতি কে দেয়? জিপি’র উত্তর, “পুলিশ দেয়।”
জবাব শুনে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন, রাস্তায় পুজো অনুমোদনের নিয়ম-কানুন সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পুলিশ কমিশনারকে আদালতে পেশ করতে হবে, এক সপ্তাহের মধ্যে। পুজোর জন্য কত দিন রাস্তা বন্ধ করে রাখা যায়, ক’দিনের মধ্যে মণ্ডপ খুলে নিতে হয়, কোথাও কোনও ব্যতিক্রম হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে কী ব্যতিক্রম সিপি’র রিপোর্টে এ সবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকতে হবে। পরিশেষে বিচারপতির বক্তব্য: যৌনকর্মীরা যদি আইন মেনে একটা পুজো করতে চান, তা হলে তাঁদের আটকানোর কোনও মানে হয় না। মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী সপ্তাহে। হাইকোর্টের এ দিনের মন্তব্য-পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে শহরের পুলিশ-কর্তৃপক্ষের কী প্রতিক্রিয়া? পুলিশ কমিশনার সুরজিত্‌ কর পুরকায়স্থ মুখ খুলতে চাননি। তবে লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, “সরকারি নীতি মেনেই কলকাতায় নতুন দুর্গাপুজোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তাই দুর্বার মহিলা সমিতি অনুমতি পায়নি।”
পুজো-পথের তরজা
কী বলল আদালত

দেখা যাচ্ছে, রাস্তা আটকে পুজো করতে গিয়ে কয়েক জন মন্ত্রী
গুন্ডার মতো আচরণ করছেন! তাঁদের জন্য কোনও নিয়ম-নীতি নেই!
কী বলেন মন্ত্রীরা
এটা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পুজো নয়। এলাকার মানুষের পুজো। সত্তর বছর ধরে হচ্ছে। লরি যাওয়ার মতো রাস্তা সব সময়ে থাকে। পুলিশ কমিশনার তিন-চার বার ঘুরে যান। গুন্ডামি হয় না, চাঁদাও তোলা হয় না। এক ইঞ্চি জমি বা রাস্তা দখল করিনি।
একডালিয়া এভারগ্রিন

আমরা জনপ্রতিনিধি। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হয়। মানুষ যেমন চান, তেমনই চলি।
সুরুচি সঙ্ঘ

রাস্তা আটকে পুজো করা কোনও কমিটির সঙ্গে আমি যুক্ত নই।
বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে মন্তব্য করব না।
রূপচাঁদ মুখার্জি লেন

এ ধরনের মন্তব্যে বিচার-ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা চলে যাবে। আমি যে সব পুজোয় যুক্ত, কেউই রাস্তা আটকায় না। গুন্ডামি, তোলাবাজির প্রশ্ন নেই।
নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ

এ সব বুঝতে গেলে পুজোর জনজোয়ারে ভাসতে হবে। মন্ত্রী হিসেবে প্রতিবাদ করে বলছি, আমাদের পুজোয় গুন্ডামি হয় না। বরং মানুষ সামিল হতে না-পারলে দুঃখ পান।
অগ্রদূত, ৭৫ পল্লি, ৬৬ পল্লি

আদালতকে সম্মান করি। আশা করি, আদালতও আমাদের যোগ্য সম্মান দেবে। সামাজিকতার খাতিরে আমরা পুজোয় যুক্ত হই। পুলিশ দেখে-শুনেই অনুমতি দেয়। গুন্ডামির অভিযোগ কখনও ওঠেনি।
চেতলা অগ্রণী
* বন্ধনীতে, সংশ্লিষ্ট পুজো কমিটির নাম

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.