গরিবের মৃত্যু সংক্রমণে, আর ধনীরা মরে ‘লাইফ স্টাইল ডিজিজ’-এ। এত দিন এমনটাই মনে করা হতো। কিন্তু চেনাজানা সেই ধারণাটাকেই নস্যাৎ করে দিল রাজ্যের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা রিপোর্ট। ‘হেল্থ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সারভাইল্যান্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, ধনী-দরিদ্রের মৃত্যুতে ব্যবধান অতটাও নেই। জীবনযাপনের মানগত কারণে গরিবেরা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন অনেক বেশি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধনীদের মতোই তাঁদেরও মৃত্যু হয় হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের সংক্রমণ কিংবা ক্যানসারে। এ তথ্যে নড়েচড়ে বসেছেন সমাজবিদেরা। বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পরবর্তী স্তরের সমীক্ষা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া জরুরি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরাও।
বীরভূম জেলায় চারটি ব্লকের ৩৩৩টি গ্রামের ১৩,০০০ পরিবারের ৫৯ হাজার মানুষকে নিয়ে শুরু হওয়া এই পপুলেশন প্রোজেক্ট এখন নজর কেড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারেরও। এই প্রকল্পটিকে মডেল হিসেবে সামনে রেখে অন্যান্য রাজ্যেও তা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর ডিরেক্টর জেনারেল বিশ্বমোহন কাটোচ জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। তাঁরাও অন্যান্য রাজ্যে প্রকল্পটি শুরু করতে চান। |
কী ভাবে সম্ভব, তা খতিয়ে দেখতে কয়েক দফায় কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা বীরভূম যাবেন। ইতিমধ্যেই বীরভূমের প্রকল্প দেখতে গ্রামে গ্রামে ভিড় জমাচ্ছেন ভিন্ রাজ্যের চিকিৎসক-গবেষকরা। বুধবার সকালেই বীরভূমের কয়েকটি গ্রামে ঘুরলেন একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য-সমীক্ষা সংস্থার প্রতিনিধিরা। সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান সঞ্জয় জুভেকর বলেন, “যে ভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ হচ্ছে, তা দেখে আমরা মুগ্ধ। এতে স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি দিকগুলির তথ্য ভবিষ্যতে হাতের কাছে মজুত পাওয়া যাবে। তা ছাড়া সংক্রামক রোগের থেকে অসংক্রামক রোগেই যে মানুষ বেশি মারা যাচ্ছেন, সেই তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারকেও পরবর্তী পরিকল্পনা তৈরির কাজে প্রভাবিত করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পশ্চিমবঙ্গ আমাদের চোখ খুলে দিচ্ছে।”
কী ভাবে দিশা দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ? বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্য যে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়, কোনও অসুখের গতিপ্রকৃতি যে চারপাশের পরিবেশ ও জীবনযাপনের উপরেই নির্ভর করে, সেই ধারণাটাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিচ্ছে এলাকা ও জনগোষ্ঠী ভিত্তিক এই সমীক্ষা। এর পোশাকি নাম ‘হেল্থ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সারভাইল্যান্স’। স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে বীরভূম জেলার চারটি ব্লককে নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘সোসাইটি ফর হেল্থ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সারভাইল্যান্স’। সেখানে শিক্ষা, পুষ্টি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে রোগ সংক্রান্ত সমীক্ষা ও গবেষণা চলছে। সমীক্ষকরা জানিয়েছেন, কে কোন রোগে ভুগছেন, কার ক’টি সন্তান, পরিবারে কেউ মারণ রোগে আক্রান্ত কি না, সে সব তথ্য জানা জরুরি।
ঠিক তেমনই কার কত জমি আছে, কে কত দূর পড়াশোনা করেছেন, পানীয় জলের উৎস কী, বাজার-খরচ কত, বাজারে ঋণ রয়েছে কি না, সে সবও জানার কাজ চলছে। কারণ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সব কিছুর যোগফলেই একজন মানুষের জীবন। আর সেই জীবনেরই প্রতিফলন তাঁর স্বাস্থ্যে। ঠিক কোথায় গিয়ে জীবনযাপনের এই মান সকলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, সেটাই ধরা পড়েছে সমীক্ষায়।
জাতীয় স্তরের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “বীরভূমের এই প্রকল্প অন্য রাজ্য অনুসরণ করবে তো বটেই, পাশাপাশি আমরাও অন্যান্য জেলায় এই কাজ ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী।” ২০০৩ সালেও এ রাজ্যের একটি প্রকল্প এ ভাবেই গোটা দেশের স্বীকৃতি পেয়ে নজির গড়েছিল। রুগ্ণ নবজাতকের চিকিৎসার জন্য ওই বছরই পুরুলিয়া হাসপাতালে তৈরি হয়েছিল একটি বিশেষ ইউনিট। তার দারুণ সাফল্যে ওই কেন্দ্রটিই ‘পুরুলিয়া মডেল’ হয়ে ওঠে। শুধু রাজ্য নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ওই মডেল ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী দেশেও। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের আশা, এ বার বীরভূমের এই পপুলেশন প্রোজেক্ট-ও সেই পথেই এগোচ্ছে। বিদেশে এই ধরনের সমীক্ষার চল শুরু হয়েছে বেশ কিছু বছর আগেই।
এই সমীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করেছে কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ। প্রতিষ্ঠানের তরফে অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী বলেন, “খুব বড় মাপের সমীক্ষায় খুঁটিনাটি তথ্য কম থাকে। তাতে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ পড়ে যায় যা একটা সমাজকে ঠিকঠাক বোঝার পক্ষে জরুরি। প্রশ্নপত্র তৈরি করার সময়ে এই দিকগুলি আমরা খেয়াল রেখেছিলাম। কাজটা অন্যদের দিশা দেখাতে পারলে আমাদেরও ভাল লাগবে।” |