বদলেছে একাদশ শ্রেণির সিলেবাস। কিন্তু বদলায়নি স্কুলের গবেষণাগারগুলির হাল।
২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে বদল এনেছে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। সংযোজিত হয়েছে বেশ কিছু আধুনিক অধ্যায়। শুরু হয়ে গিয়েছে একাদশ শ্রেণির ক্লাস। কিন্তু নতুন সিলেবাস অনুযায়ী ‘প্র্যাকটিক্যাল’ ক্লাস করার অর্ধেক উপকরণই নেই জেলার বেশির ভাগ স্কুল গবেষণাগারগুলিতে।
সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। সিঙ্গুরে নতুন কলেজের উদ্বোধনে গিয়ে তিনি বলেছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে যে স্কুলগুলি উচ্চমাধ্যমিকে উন্নীত হয়েছে সেগুলির গবেষণাগারের উন্নতির জন্য শিক্ষা দফতর থেকে অনুদান দেওয়া হবে। এই রকম ৮০০ স্কুলের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।”
তবে শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসেও আশঙ্কা কাটছে না শিক্ষকদের।
হাওড়ার ডোমজুড়ের ঝাঁপড়দহ ডিউক ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক শ্যামসুন্দর দত্তের আশঙ্কা, “স্কুলের গবেষনাগারে যে সরঞ্জাম রয়েছে সেটা দিয়ে নতুন সিলেবাস শেষ করা মুশকিল।” তাঁর ক্ষোভ, “আমি এক দশকের উপর এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এখনও পর্যন্ত একবার মাত্র শিক্ষা দফতর থেকে গবেষণাগার উন্নয়নের জন্য পনেরো হাজার টাকা পেয়েছিলাম। বর্তমান সমস্যা নিয়ে জেলা শিক্ষা দফতরকে বারবার জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি।” |
প্রায় একই কথা জানালেন জগৎবল্লভপুরের ব্রাহ্মণপাড়া চিন্তামণি ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক চিন্ময় কুমার। তাঁর ক্ষোভ, “রাজ্য সরকারের টাকায় আগে গবেষণাগারে কিছু উপকরণ কেনা হলেও সেটা যথেষ্ট নয়।” এই স্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক তরুণ ঘোষ বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানাবেন বলে জানিয়েছেন। হুগলির মাহেশের শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শশাঙ্ক শেখর মণ্ডলের মতে, রাজ্য সরকারের সিলেবাস পরিবর্তনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু আগে গবেষণাগারগুলি উন্নত করে তারপরেই নতুন সিলেবাসে হাত দেওয়া উচিত ছিল।
নতুন সিলেবাসের সঙ্গে তাল রাখতে কী কী উপকরণ লাগবে?
মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের (বালক) প্রধান শিক্ষক দিলীপ দাশ জানান, নতুন সিলেবাস অনুযায়ী গবেষণাগারগুলিকে সাজাতে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা (জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন তিনটি মিলিয়ে) খরচ হবে। ওই স্কুলেরই পদার্থবিদ্যার শিক্ষক মধুসূদন গাঁতাইতের বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব গবেষণাগারগুলিতে অন্তত ১০ থেকে ১২টি সরঞ্জাম প্রয়োজন। এগুলি ছাড়া কাজ করা যাচ্ছে না।”
একই মত উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দিলীপ ঘোষ, হুগলির হরিপাল দাড়হাট্টা রাজেশ্বরী ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক গোপাল ঘোষ, হাওড়ার মাকড়দহ বামাসুন্দরী ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
খড়্গপুরের ইন্দা কৃষ্ণলাল শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক পার্থ ঘোষ বলেন, “বেশ কিছু সেট এবং কেমিক্যাল প্রয়োজন।”
একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছেন, স্কুলগুলির গবেষণাগারে যেটুকু উপকরণ রয়েছে আপাতত সেটা দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষকেরাই তাদের বলছেন, নতুন উপকরণ ছাড়া সিলেবাসের অর্ধেকও শেষ করাও সম্ভব নয়। কিন্তু সেই ‘মহার্ঘ’ উপকরণগুলি কবে আসবে সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় কেউই।
শিক্ষা দফতর যে টাকা অনুদান দেয় তাতে যে গবেষণাগারের পুরো সংস্কার সম্ভব নয় সে কথাই প্রমাণিত হয় দুর্গাপুরের নেপালিপাড়া হিন্দি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কলিমুল হকের কথায়। তিনি জানান, গত শিক্ষাবর্ষে গবেষণাগারের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য তাঁরা শিক্ষা দফতর থেকে ২ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু গবেষণাগার সাজাতে তাঁদের খরচ হয়েছিল অনেক বেশি। তাঁর সংযোজন, “নতুন সিলেবাস অনুযায়ী অনেক নতুন জিনিস কিনতে হবে। কিন্তু এখনও এই শিক্ষাবর্ষে কোনও অনুদান পাইনি।”
তাই সরকারি অনুদানের আশায় বসে না থেকে অনেক স্কুল নিজেরাই সরঞ্জাম কিনতে শুরু করেছে। মহিয়াড়ি গ্রামের নিউ মহিয়াড়ি হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক প্রদীপ মিশ্র জানান, তাঁরা আপাতত স্কুলফান্ডের টাকা দিয়েই গবেষণাগার তৈরির কাজ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, “শিক্ষা দফতর ৩ মাস পর আমাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করে অর্থ অনুমোদন করবে বলে জানিয়েছে।”
দুর্গাপুরের বিধানচন্দ্র ইনস্টিটিউশন ফর বয়েজের অধ্যক্ষ উজ্জ্বল সরকার জানান, “বর্তমানে প্র্যাকটিকাল ক্লাসের দু’টি ভাগ। একটি ভাগ পড়ুয়ারা নিজেরাই করবে। আর একটি ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেরাই বিশদে করে দেখাবেন। প্রথম ক্ষেত্রে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমরা আপাতত বাইরে থেকে প্রজেক্টগুলি তৈরি করে নিচ্ছি।”
কী বলছে শিক্ষক সংগঠনগুলি?
এবিটিএ-র রাজ্য সম্পাদক উৎপল রায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ‘পরিকল্পনাহীনতা’র অভিযোগ এনেছেন। তিনি জানান, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ঠিকমতো করতে না পারায় সর্বভারতীয় পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়বে রাজ্যের পড়ুয়ারা। যদিও পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্য সভাপতি দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দাবি, গবেষণাগার নতুন করে সাজানোর জন্য স্কুলগুলিকে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।
দিব্যেন্দুবাবু বলেন, “২০১১ সালে প্রায় ১৮৪টি স্কুলকে পরীক্ষাগারগুলি সাজানোর জন্য ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। ২০১২ সালে প্রায় ২০০টি স্কুলকে ১ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এই বছর যেহেতু সিলেবাসের বদল এসেছে তাই সব স্কুলকেই তাদের চাহিদা অনুযায়ী অনুদান দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” |
যা প্রয়োজন |
• পদার্থবিদ্যার ল্যাবের জন্য মাইক্রোস্কোপ কম্পাউন্ড, ট্রাভেলিং মাইক্রোস্কোপ, মিটিং পয়েন্ট অ্যাপারেটাস, সারফেস টেনশন মাপার যন্ত্র, আপেক্ষিক তাপ পরিমাপক যন্ত্র, সামন্তরিক সূত্র মাপার সেট।
• রসায়নের জন্য ওজন মাপার ডিজিটাল যন্ত্র, পিএইচ মিটার, কিছু কেমিক্যাল ও গ্যাস।
• জীবনবিদ্যার জন্য সরল ও যৌগিক মাইক্রোস্কোপ, ক্রোমাটোগ্রাফি পেপার, স্লাইড, পেট্রোলিয়াম ইথার, সম্পূর্ণ মানব কঙ্কাল ও শার্ক নমুনা পরীক্ষার উপকরণ। |
|
সহ-প্রতিবেদন: সুব্রত সীট, প্রকাশ পাল, বরুণ দে, সীমান্ত মৈত্র। |