আকাশে তার নতুন করে ফিরে আসার পর্বটা একটু একটু করে শুরু হয়েছিল বছর দুয়েক ধরেই। তবে এ বারে যাকে বলে সশব্দ আবির্ভাব। পাকা রাস্তা থেকে তস্য গলি। উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে পাড়ার মাঠবেলা গড়ালেই ভেসে আসছে সমবেত কণ্ঠের তীব্র চিৎকার, ‘ভোকাট্টা’! কোথাও আবার সঙ্গে বাজছে কাঁসর-ঘণ্টাও।
বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ভাদ্রের আকাশ আবার ঘুড়িতে রঙিন। হাওয়া থাকুক নাই বা থাকুক, রোদ উঠুক নাই বা উঠুক, মাটিকে অবজ্ঞা করে সারা দিন শহরের আকাশে পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি, বগ্গার ঝাঁক। শুধু ফিরে আসাই নয়, নতুন ভাবে, নতুন রূপে, নতুন প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ঘুড়ি। সুতো থেকে মাঞ্জা, ঘুড়ি থেকে লাটাইসব বদলে গিয়েছে বিলকুল। পালটে গিয়েছে কেনাবেচার রকমও। একটা-দুটো নয়, এখন ডজন হিসেবে ঘুড়ি কিনছেন ক্রেতারা। |
নবদ্বীপের এক অস্থায়ী ঘুড়ি বিক্রেতা সুজিত ভট্টাচার্যের দোকানে বড় বড় করে নোটিস ঝোলানো রয়েছে, ‘সুতো কিনলে বারোটা ঘুড়ি বিক্রি করা হবে। শুধু ঘুড়ি কিনলে ছ’টির বেশি ঘুড়ি দেওয়া যাবে না।’ এমন ব্যবস্থা কেন? সুজিতবাবু বলেন, “এ বার রথের দিন থেকে কেনাবেচা শুরু করেছি। গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে দারুণ ব্যবসা হয়েছে। ভাদ্র মাসে তো কথাই নেই। ফলে এখন কলকাতার পাইকাররাও আর মাল দিতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই রেশনিং করতে হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে পারব না। ঘুড়ি-সুতো মিশিয়ে যা আছে, তাও রবিবারই ফুরিয়ে যাবে।”
হঠাৎ ঘুড়ির এই রমরমা কেন? দিনকয়েক আগে কলকাতা থেকে ম্যাটাডোর বোঝাই করে ঘুড়ি এনেছেন নবদ্বীপের ঘুড়ি ব্যবসায়ী নারু দাস। চার জনে মিলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা বিক্রি করেও ক্রেতা সামাল দিতে পারছেন না। প্রায় ত্রিশ বছরের পুরনো ঘুড়ি ব্যবসায়ী নারুবাবু বলেন, “আটের দশকে যখন ঘুড়ির ব্যবসা শুরু করি তখন সবে টিভি বাজারে আসছে। তারপর পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল চ্যানেলের সংখ্যা। পরিচিত হলাম ওয়ান ডে ক্রিকেটের সঙ্গে। এসবের সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে ভোকাট্টা হয়ে গেল ঘুড়ি নিজেই। টারপর টানা দশ, বারো বছর পর ২০১১ থেকে ফের ঘুড়ি উড়তে শুরু করল। সেবার থেকেই ব্যবসা আবার জমে উঠল।” ২০১১ সালে নারুবাবু ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার ব্যবসা করেছিলেন। ২০১২ তে সেটা বেড়ে দাঁড়াল দেড় লক্ষ টাকায়। এবছর নারুবাবুর কেনাবেচার পরিমাণ প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। একই সুর নবীন ঘুড়ি ব্যবসায়ী সুজিত ভট্টাচার্যের গলাতেও। তিনি বলেন, “গত বছর ত্রিশ হাজার টাকার ব্যবসা করেছি। এবছর ৭৫ হাজার টাকার ঘুড়ি বিক্রি করেছি।” ঘুড়ি নির্মাতা নিরঞ্জন দত্ত কিংবা বিক্রেতা রাজু পোদ্দারদের কথায়, “গতবারের তুলনায় আড়াই থেকে তিন গুণ বিক্রি বেড়েছে।” নবদ্বীপে এই প্রথম মহিলারাও ঘুড়ি কিনেছেন বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। “তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পালটে গিয়েছে। ঘুড়ি বলতে আগে কেবল কাগজেরই ঘুড়ি হত। শতরঞ্চি, পেটকাটি, বগ্গা, চাঁদিয়ালএ সব ছিল ঘুড়ির নাম।” বলছেন, নবদ্বীপ আদালতের আইনজীবী সুব্রত সিংহ। তিনি বলেন,“ বারো বছর বয়স থেকে সেই যে ঘুড়ির প্রেমে পড়েছি, আজও তা একই রয়েছে। মাঝে কিছু দিন ঘুড়ি ওড়ানো একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ বার তো দারুন রমরমা।” বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকেই ঘুড়ি ওড়াতেন ওই প্রবীণ আইনজীবী। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আদালতে যাবেন না। তিনি বলেন, “আমরা ছোটবেলায় ক্যালিকো সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি ওড়াতাম। সাবুর সঙ্গে কাচের গুঁড়ো, শিরীষের আঠা, তুঁতে দিয়ে মাঞ্জা হত। কেউ কেউ ডিমও দিত। এখন তো মাঞ্জা দেওয়া সুতোই কিনতে পাওয়া যায়।”
এ বার ঘুড়ি-বাজারে সিনেমার নামের ঘুড়ি ভাল কেটেছে। চার টাকা দামের প্ল্যাস্টিকের তৈরি শাহরুখ-সলমন-অমিতাভের মুখ সমেত ‘দাবাং-২’, ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ বা ‘সত্যাগ্রহ’-র চাহিদা ছিল তুঙ্গে। চাহিদা ছিল ‘ছোটা ভীম’ ঘুড়িরও। আমূল বদলে গিয়েছে লাটাই, সুতোর চরিত্রও। ঘুড়ি নির্মাতা নিরঞ্জন দত্ত বলেন, “সুতো এখন দু’ রকমের। নায়লনের আর মাঞ্জা দেওয়া। ১০০০ গজ নায়লন সুতোর দাম একশো টাকার কাছাকাছি। আর মাঞ্জা দেওয়া সুতো ৫০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি হাজার গজের দাম।” লাটাইয়ের দাম ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত। ফাইবারের লাটাই ৪০ টাকা থেকে শুরু। তবে ডিজাইনার ঘুড়িতে খুব চাহিদা তৃণমূলের ‘জোড়া ফুল’ প্রতীক চিহ্নের। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’।
পুরনো দিনের ঘুড়ি উড়িয়ে, নিত্যানন্দ মহাপাত্র বলেন, “দুটো ঘুড়ির দাম ছিল পাঁচ পয়সা। হাজার সুতো দেড় টাকা কি পাঁচ সিকি। একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হলে খান-বিশেক ছেলে ‘লগা’ নিয়ে ছুটত। এখন ছেলেদের হাতে এত পয়সা। ডজন ডজন ঘুড়ি কিনছে। ঘুড়ি কেটে গেলেও কেউ কুড়োবার নেই। কাটা ঘুড়ি রাস্তায় পড়ে থেকে ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে কালের সঙ্গে এ কালের ঘুড়ি ওড়ানোর এটাই মূল পার্থক্য।”
নবদ্বীপের এক জমিদার শিবচন্দ্র সিংহ সে কালে ঘুড়ির গায়ে টাকা আটকে ওড়াতেন। তাঁর কাটা ঘুড়ি ধরার জন্য ভিড় জমত বাড়ির সামনে। এখন ঘুড়ি নিজেই টাকা জোগান দিচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীদের। সমাজবিজ্ঞানের তরুণ গবেষক পার্থ সেনগুপ্ত বলেন, “সাইবার কাফে-র চ্যাটরুম কিংবা মোবাইলের অনর্গল কথাবার্তা ছেড়ে আবার অনেকেই আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে, ব্যবসার পাশে এটাও কিন্তু বড় পাওনা।” |