মাত্র তিন মাস আগে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট ইসলাম বিবি। আফগান পুলিশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মহিলা অফিসার। তার পর সেই পদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আর এক মহিলা। লেফটেন্যান্ট নেগার। তিন মাসও কাটল না। একই পরিণতি হল তাঁরও। অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের গুলিতে প্রাণ হারাতে হল নেগারকেও।
আফগানিস্তানে তালিবান অধ্যুষিত হেলমন্দ প্রদেশে গত কাল তাঁকে গুলি করেছিল আততায়ীরা। হেলমন্দের লস্করগায় রয়েছে পুলিশের সদর দফতর। কাল সকালে দফতরের
দিকেই যাচ্ছিলেন নেগার। হঠাৎই মোটরবাইকে হাজির হয় কয়েক জন। তাঁর ঘাড় লক্ষ্য করে ছুটে আসে গুলি। লুটিয়ে পড়েন নেগার। গুলি করেই চম্পট দেয় আততায়ীর দল। আজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় ৩৮ বছর বয়সী নেগারের। এই লস্করগায়ের রাস্তাতেই খুন হয়েছিলেন তাঁর পূর্বসূরি ইসলাম বিবি।
হেলমন্দ প্রদেশে পুলিশের সব চেয়ে মাথাব্যথা তালিবান জঙ্গিদের নিয়ে। সঙ্গে আছে মাদক পাচারকারীদের দৌরাত্ম্যও। সাম্প্রতিক কালে নেগার-সহ এই নিয়ে মোট তিন জন মহিলা অফিসার সেখানে প্রাণ হারালেন। |
লেফটেন্যান্ট নেগারের দেহ ঘিরে শোকার্ত পরিজনরা। আফগানিস্তানের হেলমন্দে। ছবি: এএফপি। |
নেগারের খুনে কোনও জঙ্গি-গোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি ঠিকই। কিন্তু মহিলা পুলিশ অফিসারদের ‘বাড়বাড়ন্ত’ তালিবান যে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না, সেটা স্পষ্ট। নেগার বা ইসলাম বিবির হত্যায় সরাসরি তালিবান যোগ না প্রমাণিত না হলেও এই কাজে তাদের হাত থাকা একেবারে অস্বাভাবিক নয় বলেই মনে করছে প্রশাসনিক মহল। আর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা ক্রমশ সরিয়ে আনার ফলে আরও চাপের মুখে পড়ছে সে দেশের পুলিশ এবং সেনা।
নেগার, শুধুমাত্র একটা নামই ব্যবহার করতেন সাহসিনী অফিসার। আফগান পুলিশে কাজ করছিলেন সাত বছর ধরে। এক কন্যা আর এক পুত্রের জননী নেগার ছিলেন লস্করগা বিমানবন্দরের দায়িত্বে। হেলমন্দের আগে কাবুলে কাজ করতেন। কিছু দিন আগে একটি মার্কিন দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, নিজের কাজটাকে অসম্ভব ভালবাসেন। গোটা আফগান পুলিশ বাহিনীর মাত্র ১% মহিলা অফিসার। পুলিশ বাহিনীতে আরও মহিলা যোগ দিন, মনেপ্রাণে চাইতেন সেটাও। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর দেশে মহিলাদের কত ভয়ঙ্কর ভাবে পারিবারিক হিংসা বা যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়। তাই মহিলাদের রক্ষায় মহিলা পুলিশের বেশি প্রয়োজন।
তাঁর সহকর্মীদের মৃত্যুর সাক্ষী হয়েও নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসার কথা কখনও ভাবেননি নেগার। বরং হেলমন্দে যে জনা তিরিশ মহিলা অফিসার তাঁর সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের সব সময় সাহস জোগাতেন। আর নিজে অনুুপ্রেরণা পেতেন লেফটেন্যান্ট ইসলাম বিবির মতো অফিসারদের দেখে। আফগানিস্তানে ২০০১ সালে তালিবান দমনপীড়নের শেষে মহিলারা স্বনির্ভর হওয়ার পথে এগিয়েছিলেন অনেকটাই। ইসলাম বিবি ছিলেন তাঁদের অন্যতম মুখ। জুলাইয়ে খুন হওয়ার আগে যিনি জানিয়েছিলেন, তাঁকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁর কাজ পছন্দ করতেন না অনেকেই। তাঁর নিজের ভাইও ছিলেন এই দলেই।
আফগানিস্তানের মানবাধিকার কমিশন জানাচ্ছে, গত দু’বছরে দেশে মহিলাদের উপরে হিংসা বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। অগ্রসর মহিলারা নানা ভাবে জঙ্গিদের কোপের শিকার হচ্ছেন। কিছু দিন আগেই ভারতীয় গুপ্তচর সন্দেহে নৃশংস ভাবে খুন হন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তালিবান জঙ্গিরাই এর পিছনে ছিল বলে দাবি। আফগান পার্লামেন্টের এক মহিলা এমপি তালিবান জঙ্গিদের হাতে অপহৃত হয়ে এক মাস পণবন্দি ছিলেন। এ মাসের গোড়াতেই মুক্তি পান তিনি। অগস্টে এক মহিলা সেনেটরের কনভয়ে গুলি চালায় জঙ্গিরা। আহত হন তিনি। মারা যায় তাঁর ন’বছরের মেয়ে। মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন নেগারও। তখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইসলাম বিবির মতো পরিণতি যদি তাঁরও হয়? নেগারের দৃপ্ত জবাব ছিল, “আমার কোনও ভয় নেই।” শেষটা তবু এক রকমই হল। রক্ষা পেলেন না নির্ভয় নেগার। |