মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক জন তৃণমূলের জোড়াফুল প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হওয়া নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রচারের ফ্লেক্সে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। অন্য জন ‘তৃণমূল সমর্থিত নির্দল’ প্রার্থী লক্ষ্মণদাস বৈরাগ্যের ফ্লেক্সে হাসছেন।
গুসকরা পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে এই চমকই শেষ নয়। যিনি দলের প্রার্থী, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিজেরই ছেলেকে বঞ্চিত করে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়া। আর দলের প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করছেন যে ‘নির্দল’, বড় নেতাদের সভা-সমিতিতে তাঁকেই তৃণমূলের মঞ্চে দেখা যাচ্ছে।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলছেন, “দলের প্রতীক নিয়ে যিনি দাঁড়িয়েছেন, তিনিই দলের প্রার্থী। আমরা কোনও নির্দলকে সমর্থন করতে পারি না।” অথচ গুসকরার দায়িত্বে থাকা তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলছেন, “যিনি জিতবেন, তিনিই আমাদের প্রার্থী।”
দেখেশুনে সিপিএম হাসছে মিটিমিটি। খেলা জমে গিয়েছে। |
গুসকরা টাউন তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি নিত্যানন্দ ওরফে নিতাইবাবু পুরনো খেলুড়ে। ১৯৯৮ ও ২০০৩ সালে এই ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই জিতেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বার পুরসভার বিরোধী দলনেতাও হন। কিন্তু পরের বার, ২০০৮-এ দল তাঁকে দাঁড় করায়নি। এ বার তিনি টিকিট পেতে মরিয়া ছিলেন। গুসকরার বাজারে যে গল্পটা চলছে, তেমনটা মুঘল আমলে শোনা যেত। টিকিটের আসল হকদার না কি ছিলেন নিতাইবাবুর ছোটছেলে মিঠুন। মসনদের দিকে তাকানোয় জাহাঙ্গির বড় ছেলে খসরুর চোখে আঠা ঢেলে অন্ধ করে দিয়েছিলেন। নিতাইবাবু ততটা না করলেও ছেলের জন্য পাঠানো প্রতীক সংক্রান্ত নথিপত্র নিজের নামে জমা করে দেন।
তৃণমূলের একটি গোষ্ঠীর দাবি, এই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ অনুব্রত মেনে নিতে পারেননি। তিনি তাই মিছিলে-সভায় খোলাখুলি লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন। কর্মিসভায় বলছেন, ‘লক্ষ্মণ, লক্ষ্মণই...।’ মুকুলবাবু মুখে ‘প্রতীক যার দল তার’ মার্কা ঘোষণা করলেও, গত শনিবার শিরীষতলায় তাঁর সভার ধারে-কাছে নিতাইবাবুকে দেখে যায়নি। লক্ষ্মণবাবুকেই বরং সভামঞ্চে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। দেওয়াসল ‘সূর্য’ প্রতীক লটকে বুক বাজিয়ে তিনি বলছেন, “আমার সঙ্গেই লড়াই সিপিএমের। ছ’শোর বেশি ভোট পাব। নিতাইবাবু দেড়শোর বেশি এগোতে পারবেন না।”
কে এই লক্ষ্মণ?
রেকর্ডবুক বলছে, অতীতে তিনি রামভক্তদের দলে ছিলেন। ২০০৩-এর ভোটে বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছিলেন। সামান্য ভোট পেয়ে রণে ভঙ্গ দেন। পরের বার তৃণমূল গুসকরা পুরবোর্ড দখল করার পরেই তাঁর জার্সি বদল এবং গোষ্ঠী রাজনীতির জটিল শাখা-প্রশাখায় পা রেখে উপরে ওঠার শুরু। বড় আশা ছিল, বিজেপি হয়ে যা তিনি পারেননি, এ বার তৃণমূলের হয়ে সেই ভোট জিতে কুর্সিতে বসবেন। |
বাদ সেধেছেন প্রবীণ নিতাই। ঘরে-বাইরে লাগাতার আক্রমণের মুখে যিনি বারবার বলছেন, “আমিই দলের মনোনীত প্রার্থী। আমায় হারাতে দলেরই একাংশ লক্ষ্মণকে লেলিয়েছে। কিন্তু লিখে নিন, আমি রেকর্ড ভোটে জিতব। লক্ষ্মণ পঞ্চাশটা ভোটও পাবে না।” এই রঙ্গমঞ্চে নেপোর ভূমিকায় সিপিএম প্রার্থী স্বপনকুমার মাঝির খুশি-খুশি গলায় একটিই সংলাপ— “ওরা নিজেদের মধ্যে লড়ে মরছে। এই ফাঁকে আমি জিতে যাব না, কে বলতে পারে?”
কার চুম্বকে কত টান, বোঝা যাবে ভোটের বাক্স খুললেই। কিন্তু ছেলের ভাত মেরে নিজে দাঁড়িয়ে পড়াটাই বা কী রকম? নিতাইবাবু ফুঁসে ওঠেন— “আমার ছোট ছেলে স্বাস্থ্য দফতরের জরুরি পরিষেবা দেওয়ার একটি বিভাগে রয়েছে। ও তো প্রার্থী হতে দরখাস্ত করেনি, বায়োডাটাও জমা দেয়নি! কী করে ওর নামে প্রতীক আসবে?” মিঠুন বলেন, “আমার সঙ্গে দলের কোনও কথা হয়নি। তবে শুনেছিলাম, বাবার জায়গায় আমাকে দাঁড় করানো হবে।”
অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ মহলে ফিসফাস, ছেলের নামে আসা প্রতীক নিজের নামে চালানোয় সাজা পেতে চলেছেন নিতাইবাবু। তাঁকে বহিষ্কারও করা হতে পারে। গলা ঝেড়ে নিতাইবাবু অবশ্য বলছেন, “আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়ের মনোনীত প্রার্থী। ওঁরাই আমায় প্রতীক দিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কারও হবে না!”
তবে শিরীষতলার সভায় এলেন না যে? আচমকাই গলাটা গম্ভীর— “আর রাজনীতি করব না। এত খোয়োখেয়ি, ঘেন্না ধরে গিয়েছে!”
|