অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল করতে বলে জাতীয় পরিবেশ আদালত সম্প্রতি যে রায় দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে এখনও সুপ্রিম কোর্টে যেতে উদ্যোগী হয়নি রাজ্য পরিবেশ দফতর বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। রাজ্য সরকারের এই ভূমিকায় ইতিমধ্যেই ক্ষোভ জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের একাংশ। রবিবার শব্দবাজির বিরুদ্ধে আয়োজিত নাগরিক সমাজের এক কনভেশনে যোগ দিয়ে অনেকেই জানিয়েছেন, রাজ্য দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকেই। রাজ্য ব্যবস্থা না নিলে এ মাসের শেষেই সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও এ দিন দাবি করা হয়।
এ দিনের নাগরিক কনভেনশনে যোগ দিয়ে রাজ্য সরকারের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটির অন্যতম সদস্য তথা বিশিষ্ট ইএনটি বিশেষজ্ঞ দুলাল বসুও বলেন, “বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল কোনও ভাবেই মানা যায় না। এমনিতেই কালীপুজোর পর দিন সকালে কানের পর্দা ফেটে যাওয়া, কান বন্ধ হয়ে যাওয়া, কানের ভিতরে ভোঁ ভোঁ শব্দ হওয়াএই ধরনের সমস্যা নিয়ে বহু রোগী আসেন। শব্দবাজি আইনি ছাড়পত্র পেয়ে যাওয়ায় এ বার ওই ধরনের রোগীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হবে।”
শুধু দুলালবাবু নন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আপিল আদালতের অন্যতম সদস্য, বিজ্ঞানী রবীন মজুমদারও এ দিন শব্দবাজির বিরুদ্ধে দেশপ্রিয় পার্কের ওই নাগরিক কনভেনশনে যোগ দেন। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলির কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চের’ উদ্যোগে হওয়া ওই সভায় প্রস্তাব নেওয়া হয়: শব্দ নয়, শান্তি চাই। যেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সঠিক আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ করুক। রবীনবাবু ওই প্রস্তাবকে পূর্ণ সমর্থন করেছেন। নাগরিক কনভেনশনে দুলালবাবু ও রবীনবাবুর উপস্থিতি নিয়ে পর্ষদের কোনও কর্তা অবশ্য মন্তব্য করতে চাননি।
যাঁর রায়ে পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি কার্যত নিষিদ্ধ হয়েছিল, কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সেই ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ দিনের নাগরিক সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “হাতি, বাঘের মতো শক্তিশালী জন্তুকে তাড়াতে চকোলেট বোমা ফাটানো হয়। শব্দবাজিকে ছাড় দেওয়া হলে ধরে নিতে হয়, মানুষ ওদের চেয়েও শক্তিশালী!”
এ দিনের নাগরিক কনভেনশনে শব্দবাজির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করার পাশাপাশি রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের পড়ুয়া এবং ক্লাবগুলির সদস্যদের সামিল করে শব্দবাজির বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তাবও নেওয়া হচ্ছে। আইনজীবী গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও বিজ্ঞানী সমর বাগচির বক্তব্য, “বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-ক্লাবে গিয়ে শব্দবাজির বিরুদ্ধে বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।” সবুজ মঞ্চের পক্ষে নব দত্ত জানান, জেলা জুড়েই এই সচেতনতা প্রসার ও প্রচারের কাজ করবে বিভিন্ন সংগঠন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “সুপ্রিম কোর্টে যেতে বলে রাজ্য সরকার ও পর্ষদের কাছে আবেদন করে আমরা চিঠি দিলেও উত্তর পাইনি। আর অপেক্ষা না করে এ মাসের শেষেই আমরা, নাগরিক সমাজ সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছি।”
১৯৯৭ সাল থেকে এত দিন পর্যন্ত এ রাজ্যে বাজির শব্দসীমা ছিল ৯০ ডেসিবেল। কিন্তু গত ২২ অগস্ট জাতীয় পরিবেশ আদালত তাদের রায়ে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গে বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল করতে হবে। আগামী এক মাসের মধ্যে এই ব্যাপারে পর্ষদকে নতুন নির্দেশিকা জারি করতে বলেছে পরিবেশ আদালত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ওই নির্দেশিকা পর্ষদ জারি করেনি।
পর্ষদ সূত্রের খবর, ওই রায়ের বিরুদ্ধে যাতে সুপ্রিম কোর্টে না-যাওয়া হয়, সে জন্য পর্ষদ ও পরিবেশ দফতরের অন্দরে প্রবল চাপ রয়েছে। কিন্তু জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায় মেনে নতুন নির্দেশিকা জারি করলে সেটা কতটা আইনসিদ্ধ হবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে পর্ষদ কর্তাদের একাংশের মধ্যে। কারণ, হাইকোর্টের নির্দেশেই পর্ষদ বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল বেঁধে দিয়েছিল এবং তাতে অনুমোদন দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টই।
শব্দবাজি নিয়ে পদক্ষেপের ব্যাপারে টালবাহানা করলেও এ দিন দুপুরে অবশ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের উদ্যোগেই সল্টলেকের সিটি সেন্টার থেকে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের মোড় পর্যন্ত পরিবেশ রক্ষার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন স্কুলের শ’পাঁচেক কচিকাঁচাকে নিয়ে একটি মিছিল বেরোয়। এবং সেই মিছিলে স্কুলপড়ুয়াদের হাতে ধরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে পরিবেশ সচেতনতামূলক অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গেই লেখা ছিল, ‘শব্দবাজি ব্যবহার করবেন না, শব্দদূষণ ছড়াবেন না।’
|