পশ্চিমবঙ্গে বেকার যুবক-যুবতীর অভাব নাই। রাজনীতি নামক কুটিরশিল্পটির বর্তমান উত্তুঙ্গ রমরমা তাহার মোক্ষম প্রমাণ। অন্য দিকে, এই রাজ্যে এখনও যে শিল্পগুলি বাঁচিয়া আছে এবং যে লগ্নিকারীরা এখনও বিনিয়োগের ঝুলি হাতে দমদম বিমানবন্দরের ভঙ্গুর কাচের দরজা পার হইবার সাহস দেখান, তাঁহারা বারে বারেই অভিযোগ করেন, এই রাজ্যে যথেষ্ট দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না। এই আপাত-বৈপরীত্যকে হেঁয়ালি ভাবিবার প্রয়োজন নাই। রহস্য যেটুকু, তাহা ‘দক্ষ’ শব্দটির মধ্যে লুকাইয়া আছে। পশ্চিমবঙ্গে চাকুরিপ্রার্থীর অভাব নাই, কিন্তু আধুনিক ক্ষেত্রে চাকুরির জন্য যে দক্ষতা আবশ্যক, তাহা নিতান্ত অমিল। ফলে, প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষাই প্রায় নির্বিকল্প রাস্তা হইয়া উঠিয়াছে। এই পরিস্থিতি বদলাইতে পারে, এমন একটি সম্ভাবনা সম্প্রতি তৈরি হইল। রাজ্য সরকার জানাইয়াছে, শিল্পমহলের সঙ্গে আলোচনা করিয়া তাহাদের প্রয়োজন বুঝিয়া লওয়া হইবে, এবং সেই চাহিদা অনুসারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হইবে। এই রাজ্যে যত পরিকল্পনা হয়, তাহার ভগ্নাংশমাত্র বাস্তবের মুখ দেখিতে পায়। সেই আশঙ্কাটি মাথায় রাখিয়াও বলিতে হয়, সরকারের সিদ্ধান্তটি অতি জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের পর আর বদলায় নাই। ফলে, শিল্প-জগতের চাহিদার ঠাঁই সেই পাঠ্যক্রমে হয় না। এই ব্যবধানটি ভরাট করিবার দায়িত্ব কাহাকেও লইতেই হইত। আদর্শ পরিস্থিতিতে বাজারই এই কাজটি করিতে পারিত। বাজার করে নাই, সম্ভবত চাহিদার অঙ্কটি এখনও তেমন স্পষ্ট নয় বলিয়াই। সে ক্ষেত্রে, সরকার তাহার দায়িত্ব পালন করিয়াছে। এই কাজটি সরকারের দায়িত্বসীমার অন্তর্ভুক্ত।
ছত্তীসগঢ়ে রমন সিংহের সরকার গত মার্চ মাসে কারিগরি দক্ষতা অর্জনকে যুবসমাজের অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়াছিল। কোনও তরুণ কোনও একটি বিশেষ কারিগরি দক্ষতা অর্জন করিতে চাহিলে রাজ্য সরকার দুই মাসের মধ্যে তাহার ব্যবস্থা করিতে আইনত বাধ্য থাকিবে। এই জাতীয় আইনে জনপ্রিয়তা বিলক্ষণ বাড়ে, কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ হয় না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে পথটি বাছিয়াছে, তাহা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পূর্বেও প্রশিক্ষণ দিত, কিন্তু তাহা কার্যত দিশাহীন ছিল। এই দফায় সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাটি এক ছাতার অধীনে আনিবার কথা বলা হইয়াছে। তাহা জরুরি। আরও জরুরি শিল্পমহলের চাহিদা জরিপ করিয়া লওয়া। শিল্পমহলকে এই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার অংশী করিবার সিদ্ধান্তটি অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এই সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত যথার্থ রূপে বাস্তবায়িত হইলে পশ্চিমবঙ্গের খেলা বদলাইয়া দেওয়ার ক্ষমতা তাহার থাকিবে। শিল্পমহল জানিবে, তাহাদের যোগ্য কর্মীর ব্যবস্থা করিয়া দিতে রাজ্য সরকার আগ্রহী। তবে, শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রেই নহে, বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রেও সরকারকে একই রকম উদ্যোগ করিতে হইবে। বৃহৎ শিল্পের প্রতি উদাসীনতাটি সম্ভবত রাজনৈতিক ‘জমি’-তে দাঁড়াইয়া আছে। মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিতে পারেন। আরও একটি কথা ভাবিয়া দেখিবার মতো। এই পথে যদি বেকার ছেলেমেয়েদের চাকুরি হয়, তাহাতেও নেত্রীর, এবং দলের, জনপ্রিয়তা বাড়িবে। ইহা জনপ্রিয়তা বাড়াইবার ইতিবাচক পথ। বেকার ভাতার ব্যবস্থাটি ইহার বিপ্রতীপ নেতিবাচক পথ। মুখ্যমন্ত্রী যখন ইতির পথে পা ফেলিয়াছেন, থামিবেন না। আরও অনেক দূর হাঁটিবার আছে। |