ভারতীয় রাজনীতিতে বানপ্রস্থ সুপ্রচলিত নহে, লালকৃষ্ণ আডবাণীর আচরণকে বিসদৃশ বা অশোভন বলিয়া সমালোচনা করিলে তাঁহার প্রতি অবিচার হইবে। কিন্তু তাঁহার আচরণে বাস্তববোধ এবং বিচক্ষণতার অভাব প্রকট হইয়াছে, এমন কথা বলিলে বোধ করি তিনিও মনে মনে তাহা মানিয়া লইবেন। প্রবীণ এবং ভূয়োদর্শী এই নেতা নিশ্চয়ই ক্রমশ উপলব্ধি করিয়াছেন যে, ভারতীয় জনতা পার্টির নায়কের আসনে তাঁহার প্রয়োজন ফুরাইয়াছে। এই উপলব্ধি তাঁহার পক্ষে বেদনাদায়ক, তাহা অস্বাভাবিক নহে। দিল্লির দরবারে বাজপেয়ী জমানায় তিনি সহনায়কের ভূমিকা পাইয়াছিলেন। অনুমান করা সহজ, পরবর্তী এক দশকে তিনি মনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্ন লালন করিয়াছেন। ২০১৪ সেই স্বপ্ন পূরণের কার্যত শেষ সম্ভাবনা। নরেন্দ্র মোদীর ছায়ায় সেই আলোকরেখা ক্রমশ ঢাকা পড়িতেছিল, আডবাণী প্রাণপণ তাহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু সুষমা স্বরাজ আদি দেউটি একে একে নিবিল। আডবাণী বলিতেই পারেন, তাঁহার সাজানো বাগান শুকাইয়া গেল।
কিন্তু বিজেপির পক্ষে মোদীকে নেতৃত্বে বরণ ভিন্ন দ্বিতীয় উপায় ছিল না। অরুণ জেটলি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন: আডবাণীর মতো প্রবীণ নায়কের প্রতি কোনও ধরনের বিরূপতা তাঁহাদের পক্ষে অত্যন্ত বেদনাদায়ক, কিন্তু দলের সমস্ত স্তরের সম্মিলিত দাবি ও আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করা সম্ভব নহে, বিধেয়ও নহে। অর্থাৎ, দল চাহিয়াছে, তাই নরেন্দ্র মোদী লোকসভা নির্বাচনে দলের ‘এক নম্বর’ প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হইয়াছেন। গত প্রায় এক বছরের ঘটনাপরম্পরা এই সত্যকেই চিহ্নিত করিয়াছে। এন ডি এ’র বিভিন্ন শরিক এবং ভারতীয় জনতা পার্টির বিভিন্ন নেতা মোদীর প্রতি যত বেশি বিরূপতা বা অন্তত বিরাগ প্রকাশ করিয়াছেন, দলের ভিতর হইতে তাঁহাকে নেতৃত্ব অর্পণের দাবি তত বেশি জোরদার হইয়াছে। অন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতারাও ক্রমশ দেওয়ালের লিখন পড়িয়া লইয়াছেন এবং মোদীর পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ভূমিকাও এই প্রেক্ষিতেই বিচার্য। মোহন ভাগবত ও তাঁহার পারিষদরা নরেন্দ্র মোদীকে ভয়ানক ভাবে পছন্দ করেন বলিয়া বিজেপির অভ্যন্তরীণ দড়ি-টানাটানিতে তাঁহার পক্ষে দাঁড়াইয়াছেন, এমন কথা মনে করিবার কোনও কারণ নাই। আর এস এস চাহে, বিজেপি নির্বাচনে সফল হউক। সাফল্যের প্রথম শর্ত: উদ্দীপ্ত লড়াই। দলের সমস্ত মহল হইতে সেই লড়াইয়ের জন্য মোদীর নেতৃত্বের দাবি প্রবল। মোদীর বিকল্প: দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, যাহা লড়াইয়ের শুরুতেই দলকে হীনবল করিয়া দিতে পারে। অতএব আর এস এস তাঁহার পিছনে। সুদূর বিংশ শতাব্দীতে ফলিত হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি গড়িতে আডবাণী যে ভূমিকাই লইয়া থাকুন, আজ তাঁহার রাজনৈতিক গুরুত্ব মোদীর তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। ইহা একুশ শতক।
বিজেপির নায়করা জানেন, মোদী সর্বজনগ্রাহ্য রাজনীতিক নহেন, মেরুকরণের প্রতিমূর্তি। নীতীশ কুমার কাহিনি দৃষ্টান্তমাত্র। ভারতে কোনও দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিশেষত যে নির্বাচনের পরিণামে জোট সরকার গঠন কার্যত অনিবার্য মনে করা হইতেছে, তাহার আয়োজনে মোদীকে নায়ক করিবার ঝুঁকি অনস্বীকার্য। অনুমান করা যায় যে, বিজেপির আশা: মোদীর নেতৃত্বে দল যথেষ্ট আসন দখল করিতে পারিলে বাস্তব রাজনীতির চাপেই বিভিন্ন দল তাহার পাশে দাঁড়াইবে, বা অন্তত বিরুদ্ধে দাঁড়াইবে না। এই অঙ্ক কত দূর সত্য হয়, তাহা ভবিষ্যৎই বলিতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই, যে ‘প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর মনোনয়ন ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী অভিযানকে একটি সুস্পষ্ট চরিত্র ও অভিমুখ দান করিয়াছে। বল এ বার কংগ্রেসের কোর্টে। |