প্রবন্ধ...
শ্রীচৈতন্য: আমাদের অপার আত্মবিস্মৃতি
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা অসাধারণ দু’টি পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছেন চৈতন্য মহাপ্রভুকে বোঝানোর জন্য। তাঁকে বলেছেন ‘কালচারাল স্পেশালিস্ট’, ‘কালচারাল মিডিয়েটর’। প্রথম শুনলে অবোধ লাগে বটে, কিন্তু তটস্থ হয়ে বিচার করলে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন চৈতন্য মহাপ্রভু। আমাদের দেশে ধর্মের দুটো ধারা আছে। একটা সেই বেদ-উপনিষদের ব্রাহ্মণ্য ধারা, যেটা একটি বিরাট দার্শনিকতা ও ততোধিক বিরাট এক আচার-আড়ম্বর ধারণ করে আছে। আর দ্বিতীয়টা হল পৌরাণিক ধারা, যা বেদ-উপনিষদকে হৃদয়ে ধারণ করেও মানুষের কাছাকাছি আসা এক লৌকিক ধারার প্রবর্তন করেছে, তারই অবশেষ ফল কিন্তু আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলি।
আমাদের দেশে বেদ-উপনিষদের শ্রুতিপ্রামাণ্য এতটাই মূল্যবান যে, কোনও ধর্ম এবং কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ই বেদ-উপনিষদের ভিত্তি ছাড়া গ্রাহ্য হত না। কিন্তু, এই যে বেদবেদান্ত আর ন্যায়-বৈশেষিকের চর্চা, যা চৈতন্য মহাপ্রভুর সমকালীন নবদ্বীপকে ভারতবর্ষের অক্সফোর্ড করে তুলেছিল, সেটা চৈতন্য-সমকালের সামাজিক পুরুষদের পরম ঈপ্সিত এক প্রচারও বটে ‘নবদ্বীপে পঢ়িলে সেহ বিদ্যারস পায়।’ চৈতন্য মহাপ্রভুও এই ন্যায়-বেদান্তের পরিবেশেই জন্মেছেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মতো ন্যায়-বেদান্তী যদি তাঁর জ্যেষ্ঠ সমকালীন হন, তাঁর কনিষ্ঠ সমকালীন সেখানে রঘুনাথ শিরোমণি। কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু বেদবেদান্তের দিকেও গেলেন না, ন্যায়-বৈশেষিকের পদার্থ-পরমাণু-বিচারের মধ্যেও গেলেন না। পড়াশুনো যতটুকু করলেন, তা ব্যাকরণ নিয়ে, কিন্তু জীবনের চর্চার ক্ষেত্রে যেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটা হল ধর্ম, এবং তাও এমন এক ধর্ম, যা ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের মধুরতর ফল আর লোকধর্মের উচ্চতর পরিশীলিত মূল।
ছবি: শ্রীচৈতন্য, শিল্পী: যামিনী রায়।
যা দাঁড়াল, তাতে এও এক ‘মঝ্ঝিম পন্থাঃ’। চৈতন্য মহাপ্রভু দ্বৈতাদ্বৈত বেদান্তের অনির্বচনীয় ব্রহ্মকে এতটুকুও অস্বীকার করলেন না, কিন্তু প্রধানত দার্শনিকের চরম-গম্য সেই তত্ত্বের একটা মধুর স্বরূপ তৈরি করলেন কৃষ্ণের মধ্যে। ‘সত্য জ্ঞান এবং অনন্ত’ রসমূর্তি ধারণ করার ফলে ঈশ্বর যেন এক অদ্ভুত শিহরণে মানুষের স্পর্শযোগ্য দর্শনযোগ্য ভূমিকায় নেমে এলেন। ও দিকে মেধা, বিদ্যা, দার্শনিক এবং বৈরাগ্যের সাধনে যাঁকে অনেক কষ্টে ‘আমিই তিনি, কিংবা তিনিই আমি’ বলে জ্ঞানমার্গে ধ্যান করতে হত, চৈতন্য ভক্তিমার্গ আর আত্মনিবেদনের বশীকরণ তৈরি করলেন সেই ঈশ্বরকে বেঁধে ফেলার জন্য। ঈশ্বরকেই বুঝতে হল, একক, একাকিত্ব ও সর্বময়ত্বের চেয়ে মানুষের আপন রসস্বরূপে লীলায়িত হওয়ার আস্বাদন অনেক বেশি। জ্ঞানগম্যতার মোহ কাটিয়ে ‘রসো বৈ সঃ’ যখন মানুষের দাস্যে, সখ্যে, বাৎসল্যে মধুর রসে ধরা দেন, তখন অদ্বৈতের ব্রহ্ম সগুণ, সবিশেষ হয়ে সমস্ত কল্যাণগুণে মানুষের ভক্তির বিষয় হয়ে ওঠেন।
আসলে লৌকিক দেবতার আশ্রয়ে মনসা, বিষহরি আর মঙ্গলচণ্ডীর উপাসনায় যে লৌকিক ভক্তি আর লৌকিক যুক্তি ছিল ‘লিটল ট্র্যাডিশন’-এর ব্যাপার এবং ব্যবহার, সেটাকে মহাপ্রভু চৈতন্য উন্নীত করলেন জ্ঞানের উপরিস্তরে, আর অদ্বৈত ব্রহ্মানুসন্ধানের সাধন যে জ্ঞান, সেই জ্ঞানকে তিনি নামিত করলেন কৃষ্ণানুশীলনের কর্মপন্থায় শ্রবণ, কীর্তন, অর্চন, বন্দন, আত্মনিবেদনের মধ্যে। শুষ্ক জ্ঞান হয়ে উঠল রস। ‘গ্রেট ট্রাডিশন’ আর ‘লিটল ট্রাডিশন’-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দার্শনিক আর সাধারণ মানুষকে তিনি একত্তর করে দিলেন। পড়াশুনোর জায়গায় বেদান্ত পড়তে বললেন না, বললেন ভাগবত পুরাণ পড়তে। এটাই নাকি তাঁর ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য।
প্রাজ্ঞ পণ্ডিত প্রয়াত হীরেন মুখোপাধ্যায় এক বার বলেছিলেন: বাংলার রেনেসাঁস ব্যাপারটা চৈতন্যের আমলেই প্রথম খোঁজা উচিত। সত্যি বলতে কী, চৈতন্য মহাপ্রভুকে কেন্দ্র করে যে বিশাল সাহিত্য, শিল্প এবং সামাজিক উদারতার পথ তৈরি হয়েছিল, তা দ্বিতীয় বার উদ্যাপিত হয়েছে ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বাংলায়। এ প্রসঙ্গে অন্য সময়ে আসতে হবে। তবে শুধু তাঁর ধর্মান্দোলনের কথা যদি বলি, তা হলে দেখা যাবে, চৈতন্য এবং চৈতন্য-পার্ষদরা অন্তর্হিত হলে এক সময় যেমন শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু, শ্যামানন্দ প্রভু এবং নরোত্তম দাস ঠাকুর সেই আন্দোলনের স্তিমিত প্রদীপ উসকে দেন, ঠিক তেমনই এই বিংশ শতাব্দীর দুই-তিন দশকে তাঁর ভাবনাগুলি আবারও যখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন আরও এক বার তার পুনর্জাগরণ তৈরি হল, কিন্তু পণ্ডিত গবেষকেরা তার ইতিহাস রচনা করতে ভুলেই গেলেন।
লক্ষণীয়, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের এই আন্দোলনও কিন্তু দু’টি ধারায় তৈরি হয়েছিল। এখানে ‘অ্যাক্টিভিটি’ যে ধারা, সেখানে প্রথম নাম আসবে এখনকার গৌড়ীয় মঠ-মিশনগুলির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী মহাশয়ের। প্রসিদ্ধ ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের পুত্র এবং শিষ্য এই মহাপুরুষ বাগবাজার গৌড়ীয় মঠ থেকে তাঁর প্রচার শুরু করেন। দিকে দিকে শাখা মঠগুলি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে দুষ্প্রাপ্য ভক্তিগ্রন্থগুলিও সেখান থেকে বেরোতে থাকে। দেশে-প্রদেশে গৌড়ীয় মঠ প্রতিষ্ঠা করে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী বিপুল কর্মশক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। মনে আছে, পূর্ব-পাকিস্তানের পাবনা জেলার একটি ছোট্ট গ্রামে আমার শৈশবে সেই ছোট বয়সে পিতৃদেবকে দেখতাম ‘দৈনিক নদীয়া প্রকাশ’ পত্রিকা মাঝে মাঝেই গুছিয়ে একত্র করতেন বাঁধাই করার জন্য। পত্রিকাটি বেরোত মায়াপুর থেকে।
নবদ্বীপের প্রায় প্রতিস্থানে মায়াপুরকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাগবাজার গৌড়ীয় মঠে লুপ্ত-প্রাচীন গৌড়ীয় গ্রন্থগুলির প্রকাশও আরম্ভ হয়েছিল। মঠের প্রতিস্থানে বিশালধী পণ্ডিতরা ছিলেন, অ্যাক্টিভিস্টের জায়গাতেও ছিলেন বিশিষ্টজনেরা, যাঁদের কথা গবেষকোচিত চেতনায় কেউ সে ভাবে ভাবলেনই না এখনও।
সে দিক থেকে বাগবাজার গৌড়ীয় মঠ অন্তত স্বচেতনায় ফিরতে চাইছে। আজ রাষ্ট্রপতি সেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সংগ্রহশালার শিলান্যাস করবেন। এই উদ্যোগ যদি নতুন চিন্তা ও চর্চার প্রেরণা দেয়, আত্মবিস্মৃতির দায় থেকে আমরা কিছুটা মুক্তি পাব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.