খবরের কাগজে ছবিতে দেখলাম, আমার দাদাদের মাথা, গলা ও মুখে ব্যান্ডেজ করা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ওদের সঙ্গে আর কথা বলতে পারিনি। বাবাকে অনেক বার বলেছি, আমাকে এক বারের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। ফোনে কথা বলতে চেয়েছিলাম। বাবা বলল, দাদারা এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আমি জানি, দাদারা খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওরা একদম ভাল নেই।
এই ঘটনার পর থেকে মা ভীষণ ভেঙে পড়েছে। সারাদিন দাদাদের জন্য কান্নাকাটি করছে। কিছুই খেতে চাইছে না। মা হার্টের রোগী। পেসমেকার বসানো হয়েছে গত বছর। মা, দাদাদের এই অবস্থার জন্য এখন আমার নিজেকেই দায়ী বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অপমানটা চুপচাপ মেনে নেওয়াই উচিত ছিল। তা হলে তো দাদাদের এই ক্ষতি হত না। এখন ভাবছি, অন্যদের মতো যদি আমিও মাথা নিচু করে চলে আসতাম তা হলেই হয়তো ভাল হত।
ব্যাপারটা যে এ রকম হয়ে যাবে, বুঝতে পারিনি। দাদারা আমাকে সব সময় বলে, রাস্তায় কোনও বিপদে পড়লেই যেন সঙ্গে সঙ্গে ওদের জানাই। আমি টিউশন থেকে রোজ রাতে ওই রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরি। ওই ছেলেগুলোকে আগেও দেখেছি, ওইখানে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েরা রাস্তা দিয়ে গেলেই তাদের টিটকিরি দেয়। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। সব অপমান সহ্য করে ওই জায়গাটা পার হয়ে যায়।
কিন্তু আমার সঙ্গে এ রকম আগে কখনও ঘটেনি। ওই রাতে আমাকে দেখে ছেলেগুলো কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে গান শুরু করেছিল। আমার সঙ্গে এক বন্ধু ছিল। ওরা ছিল চার জন। আমি মাথা নিচু করে জায়গাটা পেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তার মধ্যেই এক জন এসে আমার হাত ধরে টানতে থাকে। আমি আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকি। ভয়ে আমার বন্ধু ছুটে পালিয়ে যায়। আমি কোনও মতে ওদের হাত ছাড়িয়ে মোবাইল বার করে দাদাদের ফোন করি। আমাদের কারখানাটা ওই জায়গার খুব কাছেই। ফোন পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দাদারা চলে আসে।
দাদারা কিন্তু ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি। দাদারা ওদেরকে যখন বোঝাচ্ছিল তখন উল্টে ওরাই দাদাদের ধমকাচ্ছিল। যেন ওরা যা করেছে বেশ করেছে! দাদাদের কথা শুনে তখন আমি ছুটে বাড়ি চলে আসি। তার পরে ওখানে কী হয়েছে, দাদাদের সঙ্গে ওদের কী কথা হল, জানতে পারিনি। দরজায় বেল বাজানোর পরে মা দরজা খুললে মা-কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। আমার মুখ থেকে ঘটনাটা শুনে বাবাও গায়ে একটা জামা গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওরা এলাকার বখাটে ছেলে। মা তাই বাবাকে বারবার সাবধান করে দিচ্ছিল। বাবার মুখ থেকে পরে শুনি, ওদের সঙ্গে দাদাদের ধস্তাধস্তি হয়েছিল। তার পরে বাবার সঙ্গে এলাকার আরও কিছু লোক প্রতিবাদ করায়, ওরা তখনকার মতো পালিয়ে যায়। তবে রাত দশটা নাগাদ জনা কুড়ি ছেলেকে নিয়ে ওরা ফিরে আসে। ওদের হাতে রড-ব্লেড-ক্ষুর-ভোজালি ছিল। দাদাদের মাটিতে ফেলে ওরা মাথায় রড দিয়ে মারে, ভোজালি দিয়ে মারে। মুখ, গলায় ভোজালি, ক্ষুর দিয়ে এমন ভাবে মারে যে কারখানায় রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। বাবা তখন বাড়িতেই ছিল। খবর পেয়ে কারখানায় ছুটে গেলে বাবার আঙুলেও ভোজালি দিয়ে কোপ মারে ওরা। আর একটু হলে বাবার আঙুলটাই আলাদা হয়ে যেত। আমাদের ফোন পেয়ে মামাও তাড়াতাড়ি কারখানায় যায়। আমার দাদারা তখন ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় কারখানাতেই পড়ে ছিল। মামা যেতেই ওই গুণ্ডাগুলো দাদাদের ওই অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। আর পুলিশকে যাতে কিছু জানানো না হয়, সে জন্য হুমকিও দিয়ে যায়। এখন বাইরে বেরোতেই ভয় করছে আমার। ভয় পাচ্ছি বাবা আর দাদাদের নিয়েও। ছেলেগুলো যদি আবার ওদের কোনও ক্ষতি করে! বাড়িতে সবাই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায়। বাবা-মা বলছেন, কোনও বিপদ হলে সঙ্গে সঙ্গেই যেন জানাই। কিন্তু এই ঘটনার পরে আর সেটা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। |