মোমবাতি হাতে পথে নামল প্রতিবাদী তপসিয়া
থচলতি মেয়েদের টিটকিরি, শ্লীলতাহানির ঘটনা দেখার পরেও এত দিন প্রতিবাদ করতে ভরসা পাননি তাঁরা। বোনের শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তিন দাদা গুরুতর জখম হওয়ার পরে আর ঘরে বসে থাকতে পারলেন না তপসিয়ার বাসিন্দারা। রবিবার ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করে, সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে পথে নেমে এলেন কয়েক হাজার মানুষ। স্মারকলিপিতে সই করে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদ এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিও জানান তাঁরা। শুক্রবার রাতের ওই ঘটনার পরে রবিবার পর্যন্ত মাত্র এক জন অভিযুক্তকেই গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ।
ওই রাতে তপসিয়া রোডে ওই কিশোরীকে বাঁচাতে এসে জনা বিশেক দুষ্কৃতীর হাতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন তার তিন দাদা সাদাব আলম, মহম্মদ জায়েদ ও মহম্মদ মেহতাব। তিন জনই গুরুতর আহত অবস্থায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। ঘটনার রাতেই ওই ছাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে সঞ্জু, কলিম, হায়দার, করিম ও রাজ-ও কয়েক জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। পুলিশ এর মধ্যে শুধু রাজকেই গ্রেফতার করতে পারে। শনিবার রাতে আরও দু’জনকে আটক করা হলেও পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ জানায়, মূল অভিযুক্ত-সহ অন্য অভিযুক্তদের সন্ধানে তল্লাশি চলছে।
তপসিয়ায় এ ভাবেই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। রবিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
পুলিশের এই আচরণেই ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসী। এ দিন দুপুরে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই পথে নেমেছিলেন তাঁরা। ফেস্টুনে লেখা ‘মা-বোনেদের ইজ্জত নিয়ে খেলা। বোনকে বাঁচাতে গিয়ে গুণ্ডাদের হাতে মার খেয়ে তিন ভাই হাসপাতালের বিছানায়।’ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাজারখানেক বাসিন্দা স্মারকলিপিতে সই করে প্রতিবাদে সামিল হন। অটোযাত্রী থেকে শুরু করে পথচলতি মানুষ, সকলেই তাতে অংশ নেন। বিকেলে তপসিয়ার বেলাল মসজিদের সামনে থেকে বেরোয় প্রতিবাদী মিছিল। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন হাতে কয়েক হাজার বাসিন্দা তাতে যোগ দেন। শুক্রবারের ঘটনাস্থলের কাছেমোমবাতি জ্বালিয়ে চলে প্রতিবাদ। পরে তপসিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মিছিল যায় তিলজলা থানায়। মিছিলে এলাকার ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং চামড়ার ব্যবসায়ী মহম্মদ ইকবালের অভিযোগ, এলাকায় দুষ্কৃতীদের হাতে বারে বারে আক্রান্ত হচ্ছেন এলাকার ছাত্রী ও মহিলারা। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা ওই দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কেউ পুলিশে অভিযোগ করার সাহস পান না বলে তাঁর দাবি। এলাকার মহিলারা জানান, এর পরেও যদি পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করে, তা হলে তাঁরাও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবেন। আর এক স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াসিন রিজভি জানান, পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে শনিবারই পথে নামতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তিনি বলেন, “প্রশাসন আশ্বাস দেয়, রবিবারের মধ্যেই অভিযুক্তেরা ধরা পড়বে। কিন্ত পুলিশ কথা রাখেনি। তাই আজ আমরা পথে নেমেছি।” এলাকার বাসিন্দা শামিমা রিজওয়ান বলেন, “আমরা যদি এখনও এর প্রতিবাদ না করি, তা হলে ওই দুষ্কৃতীরা এক দিন আমার মেয়ের উপরেও চড়াও হবে।”
এক দিকে যখন পাড়ার মেয়ের শ্লীলতাহানি ঘিরে এই ঘটনায় ক্ষোভে-প্রতিবাদে সরব গোটা পাড়া, সেই কিশোরী তখন অবশ্য ভুগছে অপরাধবোধে। তার জন্যই আজ তিন দাদার এই হাল, বাড়িতে না জানালে যে পরিস্থিতি হয়তো এড়ানো যেত। অসম্মানটুকু নিজে নিজেই সয়ে নেওয়া হয়তো বা ভাল ছিল এই ভাবনাগুলোই তাকে কুরে কুরে খেয়েছে দিনভর।
পরপর শ্লীলতাহানি-ধর্ষণ এবং প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যু কিংবা আহত হওয়ার ঘটনা কি তবে এই ধরনের অপরাধবোধ বা বিপদের কথা কাউকে না জানানোর এক নতুন প্রবণতার জন্ম দিচ্ছে? এই অপরাধবোধের মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব দেখছেন না মনস্তত্ত্ববিদ থেকে লেখক কিংবা নারী আন্দোলনের কর্মী, কেউই। তবে একই সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেকেরই বক্তব্য, বাড়িতে না জানালে মেয়েটির হয়তো আরও বড় কোনও বিপদ হতে পারত। মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, “বিপদে পড়ে অন্যের সাহায্য চাওয়াটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু কঠিন বাস্তব এ ভাবে ব্যথা দিলে আবেগকে সরিয়ে রেখে যুক্তি এবং বাস্তবতাবোধ দিয়েই সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। ভাবতে হয় যে রাস্তাঘাটে অন্য কাউকে বাঁচাতে গেলেও এমন ঘটতে পারত।” নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ আবার বলছেন, “এক দিকে যেমন তার জন্যই এমন হল, এই দুঃখটা কাজ করে, তেমনই বহু ক্ষেত্রে মেয়েটির দিকে আঙুলও তো ওঠে। তাই সহ্যের সীমা না ছাড়ালে বাড়িতে না জানাতে চাওয়ার এই প্রবণতাটা তৈরি হয়। কারণ প্রথমত, বাড়ির উপর আঁচ আসুক সে চায় না। দ্বিতীয়ত, সে স্বাধীনতাটা হারিয়ে ফেলতে চায় না। বাড়ির লোক শুনলে হয়তো ভয় পেয়ে তার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেবে। তাই মেয়েটি প্রথমে নিজের মতো করে বিপদ এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু এমন হবে কেন? পুলিশ বা প্রশাসনেরই তো উচিত মেয়েটির সুরক্ষিত থাকাটা নিশ্চিত করা।” লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কথায়, “প্রবণতাটা কেন? দোষটা তো আসলে সমাজেরই। এই সব দুষ্কৃতীরা কোথাও থেকে সাহস পাচ্ছে যে তারা যা-ই করুক না কেন, ঠিক পার পেয়ে যাবে। এটা রোখা দরকার। চাই কড়া শাস্তি। সেই সঙ্গে মেয়েদের পণ্য হিসেবে দেখাটাও যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনই মেয়েদেরও খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন এমন কিছু না করে যা বিপদ ডেকে আনতে পারে।”
তপসিয়ার এ দিনের মিছিল মনে করিয়ে দিয়েছে রাজীব-হত্যার পরে বারাসতবাসীর পথে নেমে লড়াইয়ের কথা। আড়াই বছর আগে বারাসতে দিদির সম্মান বাঁচাতে গিয়ে খুন হয়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব দাস। এ দিন রাজীবের দিদি রিঙ্কু দাস বলেন,“ভাইয়ের মৃত্যুর এত দিন পরেও কোনও অভিযুক্তের সাজা হয়নি। যদি অভিযুক্তেরা সাজা পেত, হয়তো দুষ্কৃতীরা একটু হলেও ভয় পেত।”
রবিবার তপসিয়ার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দলের মূল পান্ডা। পুলিশ জানায়, সঞ্জু ও অন্য অভিযুক্তেরা ফেরার। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ, সঞ্জুকে পাড়ায় দেখা গিয়েছে। তাঁদের দাবি, অন্য অভিযুক্তেরাও পুলিশের নাকের ডগাতেই রয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, সঞ্জু-সহ বাকি অভিযুক্তরা তপসিয়া সেকেন্ড লেনের বাসিন্দা। সঞ্জুর একটি ছোট ট্যানারি রয়েছে। সেটি অবৈধ বলে দাবি তদন্তকারীদের। শনিবার রাতে সেখানে হানাও দেন পুলিশকর্তারা। কিন্তু তাঁদের খালি হাতেই ফিরতে হয়। পুলিশ জেনেছে, সঞ্জুর ভাইও শুক্রবারের ঘটনায় জড়িত। বাকি অভিযুক্তেরা প্রত্যেকেই এলাকায় ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত।
কোপে পরিজনেরা
• ১৪ ফেব্রুয়ারি ’১১—বারাসতে দিদির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে মৃত্যু রাজীব দাসের।
• ৮ ফেব্রুয়ারি ’১২—বিমানবন্দর থানার বিশরপাড়ায় ভাগ্নির সম্মান বাঁচাতে গিয়ে মৃত পুলিশকর্মী অসীম দাম।
• ১৫ ফেব্রুয়ারি ’১২—কাঁকিনাড়া স্টেশনে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করে প্রহৃত দাদা।
• ১ ফেব্রুয়ারি ’১৩—বারাসতে টিউশন থেকে ফেরার পথে শ্লীলতাহানি একাদশ শ্রেণির ছাত্রীর। প্রতিবাদ করে প্রহৃত বাবা ও দাদা।
• ২৪ ফেব্রুয়ারি ’১৩—বারাসতের বামনগাছিতে মদ্যপদের হাত থেকে বোনকে বাঁচাতে গিয়ে জখম ভাই ও দাদা।
• ২২ জুলাই ’১৩—হাওড়া স্টেশনে রাতে শ্লীলতাহানি মুম্বইয়ের তরুণীর। প্রতিবাদ করায় মারধর বাবাকে।
• ২৩ জুলাই ’১৩—স্ত্রী ও পুত্রবধূর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করে দমদমে প্রহৃত মেট্রো-আধিকারিক।
• ৪ অগস্ট ’১৩—বর্ধমানের দাঁইহাটে দুই বোনের শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে গুলিতে নিহত গণেশ মুর্মু।
• ১৩ অগস্ট ’১৩—তপসিয়া রোডে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করে প্রহৃত তিন দাদা ও বাবা।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.