ওঁরাও সবাই মা, তাই মায়ের দুঃখে সমব্যথী। শিক্ষিকা নন, মা হিসেবেই পঞ্চম শ্রেণির প্রয়াত ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাসের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তাঁরা। তাতেই পরিস্থিতি যেন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হল শিশুহারা পরিবারে।
ঘড়িতে তখন সন্ধে সাতটা ছুঁইছুঁই। ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ন’জন শিক্ষিকা এসে পৌঁছন বাগুইআটি ঘোষপাড়ায় ঐন্দ্রিলার বাড়িতে। রবিবার সকাল থেকেই বিছানা নিয়েছেন ঐন্দ্রিলার মা রেখাদেবী। সংবাদমাধ্যম বা বাইরের কাউকে দেখলেই ঐন্দ্রিলার বাবা শান্তনুবাবু অসহায় গলায় বলছেন, “কিছুই খাচ্ছে না। এ রকম করলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। কী করব, বুঝতে পারছি না।”
স্কুলের শিক্ষিকাদের দেখে সেই শোক বাঁধ ভাঙল। ডুকরে কেঁদে উঠলেন রেখাদেবী। স্কুলের দুই শিক্ষিকা কুমকুম দাস ও বনানী সেনগুপ্ত তখন রেখাদেবীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছেন, “আপনার কষ্টের আমরা সবাই সমব্যথী। আমরাও তো সবাই মা। আপনাকে কী সান্ত্বনা দেব। শুধু এটুকু বলতে পারি, ঐন্দ্রিলার প্রাণদান যেন ব্যর্থ না হয়, সেটা দেখব।” এর পরে মাকে ঘিরেই প্রার্থনায় বসলেন শিক্ষিকারা। প্রার্থনার মধ্যে শপথ নিলেন, “ঐন্দ্রিলা সব সময়েই শিখিয়ে গিয়েছে, শিশুদের ভালবাসো। আমরা যেন আমাদের ত্রুটি সংশোধন করতে পারি।” |
ঐন্দ্রিলার মাকে সান্ত্বনা সূর্যকান্ত মিশ্রের। —নিজস্ব চিত্র। |
প্রার্থনা শেষ হতেই শান্তনুবাবু অনুরোধ করেন, “ও তো কিছুই খাচ্ছে না। আপনারা দেখুন না, যদি কিছু খাওয়াতে পারেন।” বাবার আর্তি শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শিক্ষিকারা। নিজেরাই রান্নাঘর থেকে বাড়ির লোককে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করে ফেললেন শরবত। কুমকুমদেবী-বনানীদেবীরা এর পরে খানিকটা জোর করেই খাটে বসালেন মাকে। বললেন, “না খেলে কী করে চলবে। আমাদের সামনে একটু অন্তত খান।” শিক্ষিকাদের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না রেখাদেবী। তাঁদের হাত থেকেই খেলেন বিস্কুট আর শরবত।
এ দিন সকাল থেকে বাইরের কারওর সঙ্গে সে ভাবে দেখাই করতে চাননি ঐন্দ্রিলার মা। বিকেলে ঐন্দ্রিলার বাড়িতে যান রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। সূর্যবাবুকে দেখে কেঁদে ওঠেন রেখাদেবী। বলেন, “এত কিছু হচ্ছে, মেয়ের মৃত্যুর বিচারের কী হল? চিকিৎসক আর ওই তিনটি স্কুলছাত্রী যারা আমার মেয়েকে আটকে রেখেছিল, তাদের তো কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করছে না! আর স্কুলের রক্ষী!”
সূর্যবাবু মীরাদেবীর হাত ধরে বলেন, “মা, তোমার মেয়ে আমার নাতনি-সম। আমার সান্ত্বনা দেওয়ার কোনও ভাষা নেই। তোমাদের অভিযোগের কাগজপত্র আমার কাছে পাঠিও। যেখানে প্রয়োজন, সেখানে আমি ঠিক দিয়ে আসব।” সূর্যবাবু যখন বেরিয়ে আসছেন, সেই সময়ে ঐন্দ্রিলার বাবা বলে ওঠেন, “দেখবেন, আমার মেয়ের মৃত্যুর জন্য স্কুলে যেন শোকের পরিবেশ আর না থাকে। এতে ছেলেমেয়েরা দুঃখ পাবে। পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আর স্কুলটাকেও সরকারকে আরও ভাল করে তৈরি করে দিতে বলুন।”
শান্তনুবাবুর বক্তব্য, “শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই। শিক্ষিকারা কখনও অসৎ শিক্ষা দেন না। আমাদের অভিযোগ ওই তিন ছাত্রীর বিরুদ্ধে।” তবে এ দিন শিক্ষিকারাও দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি। ঐন্দ্রিলার মায়ের সঙ্গে দেখা করার পরে শিক্ষিকা বনানী সেনগুপ্ত বলেন, “আমরা ঘটনাটি জেনেছি পরের দিন সাংবাদমাধ্যমের থেকে। আমরা হতবাক। যে ভাবে ঐন্দ্রিলাকে আটকে রাখা হয়েছিল, তাতে নিজেরাই আমরা নিজেদের দায়ী করছি। শিক্ষিকারা তো মানুষ গড়ার কারিগর। তবে কি আমরা শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়লাম!” তবে দোষী ছাত্রীরা যাতে বিপথে চলে না যায়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে বলে মনে করেন বনানীদেবীরা। তিনি বলেন, “ওদের হয়ে আমরা মার্জনা চাইছি। কিন্তু ওরা যাতে জীবনের মূলস্রোত থেকে ছিটকে না যায়, সেটাও দেখতে হবে।”
এর মধ্যেই শিক্ষিকারা জানান, তাঁরা অধ্যক্ষা হেলেন সরকারের পাশে আছেন। শিক্ষিকা কুমকুম দাস বলেন, “দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত ওঁর পাশেই আছি আমরা।” উঠে এল স্কুল ভাঙচুরের ঘটনাও। শিক্ষিকারা বললেন, বিক্ষোভ অনেক ভাবেই দেখানো যেত। কিন্তু যে ভাবে অভিভাবক এবং বহিরাগতরা ভাঙচুর চালালেন, শিক্ষিকাদের দিকে জুতো তুলে দেখালেন, তা লজ্জাজনক। আতঙ্ক এখনও পুরোপুরি কাটেনি তাঁদের। শিক্ষিকা শিখা মণ্ডল বললেন, “কোনও রকমে এ দিন একজোট হয়ে আমরা আসতে পেরেছি। কী করে স্কুলে যাব, এখনও জানি না।” আর এক শিক্ষিকা প্রণতি সরকার বলেছেন, “আমরা সকলে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তা চাইব।” ঐন্দ্রিলার বাড়িতে ঢুকেই বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো সারদা মায়ের ছবি। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে প্রণতিদেবী বললেন, “খুব হাসিখুশি মেয়ে ছিল। আমাকে মাঝেমধ্যেই বিবেকানন্দ, মা সারদার ছবি দিত। এই ছবিটাও মাসকয়েক আগেই আমাকে দিয়েছিল। এখনও আমার কাছে রাখা আছে।” তাঁর আক্ষেপ, “দূর থেকে আমাকে দেখলেই হেসে চোখ পিটপিট করত। এত কথা হতো। এক বারও এই কথাটা বলল না। তা হলে এক বার অন্তত চেষ্টা করে দেখতাম।” |