মানুষগুলির সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তাঁদের দেখা হয়। খবর নেন ভাল-মন্দের। অথচ বৃহস্পতিবার তাঁদেরই একাংশের বীভৎস চেহারা মনে পড়লে এখনও আতঙ্কে শিউরে উঠছেন বনানী সেনগুপ্ত, কুমকুম দাস এবং পাপড়ি বসুরা। ওঁরা সকলেই দমদম ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের শিক্ষিকা। বৃহস্পতিবার তাণ্ডবের সময় তিন জনেই আটকে ছিলেন স্কুলে।
বনানীদেবী ও কুমকুমদেবী ১৯৭৯ সাল থেকে পড়াচ্ছেন ওই স্কুলে। পাপড়িদেবী যোগ দেন ২০০১ সালে। বনানীদেবী পড়ান জীবনবিজ্ঞান, কুমকুমদেবী বাংলা, পাপড়িদেবী ইংরেজি। বৃহস্পতিবারের তাণ্ডবে ওঁরা প্রাণ বাঁচাতে সারা দিন স্কুলের এ-ঘর থেকে ও-ঘর, একতলা থেকে দোতলা ছুটে বেড়িয়েছেন তাঁরা। অন্ধকার ঘরে কাটাতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জল জোটেনি। শৌচাগারে পর্যন্ত যেতে পারেননি কেউ। চোখের সামনে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখেছেন সহকর্মী সুস্মিতা হালদারকে। এক সময় মনে হয়েছিল, বোধ হয় আর প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন না। বাড়ির মানুষগুলির মুখগুলি মনে পড়ছিল বারবার। |
|
|
|
বনানী সেনগুপ্ত |
কুমকুম দাস |
পাপড়ি বসু |
|
ওই ঘটনার তিন দিন পরে, রবিবারেই প্রথম কিছুটা ধাতস্থ মনে হচ্ছিল বনানীদেবীদের। তাঁরা এত দিন যাঁদের মেয়েদের যত্ন নিয়ে পড়িয়েছেন, মেয়েদের ভালমন্দ নিয়ে যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই অভিভাবকদের একাংশ যে এ ভাবে তাঁদের গালমন্দ করতে পারেন, ভাবতে পারছেন না ওই শিক্ষিকারা। এর পরে তাঁদের মেয়েদের পড়াতে গিয়ে অভিভাবকদের হিংস্র মুখগুলি চোখের সামনে
ভেসে উঠবে কি না, সেটাই ভাবাচ্ছে অনেক শিক্ষিকাকে।
বনানীদেবী শুধু যে ৩৪ ধরে ওই স্কুলে পড়াচ্ছেন তা-ই নয়, তিনি ওখানকার প্রাক্তনীও। বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটি থাকায় বাড়ি থেকে বেরোননি। কিন্তু ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ স্কুল থেকে এক সহকর্মী ফোন করে তাঁকে জানান, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাসের মৃত্যুর প্রতিবাদে লোকজন স্কুলে ঢুকে গণ্ডগোল করছে। “খবরটা পেয়ে আর বাড়িতে বসে থাকতে পারিনি। এটা আমার নিজের স্কুল। এখানে পড়েছি। এখন পড়াচ্ছি,” বললেন বনানীদেবী।
ক্রাইস্ট চার্চের জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষিকা বনানীদেবী বলেন, “স্কুলে পৌঁছে দেখি, বাইরে রীতিমতো তাণ্ডব চলছে। অধ্যক্ষাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে চিৎকার করছে উন্মত্ত জনতা। সেই ভিড়ে কিছু অভিভাবকও ছিলেন। তাঁদের চিনতে ভুল হয়নি। তবে জনতার মধ্যে বেশির ভাগই বহিরাগত। আমার নিজের স্কুলে এমন ঘটনা ঘটছে, বিশ্বাসই হচ্ছিল না!”
বিহ্বলতার মধ্যেও সক্রিয় ছিল আত্মরক্ষার তাগিদ। তিনি স্কুলের শিক্ষিকা, এটা জানতে পারলে তাঁর যে রেহাই নেই, বুঝতে পারছিলেন বনানীদেবী। তিনি বললেন, “নিজেকে কোনও মতে আড়াল করে ভিড়ের ভিতর দিয়েই সোজা চলে গেলাম স্টাফরুমে। ভিতরে তখন যে-ক’জন শিক্ষিকা ছিলেন, সকলেরই চোখেমুখে চাপা আতঙ্ক। বুঝতে পারি, গোলমাল বাড়ছে। হঠাৎই দেখি, এক দল লোক স্টাফরুমে ঢুকে পড়েছেন। তাঁদের মুখে অশ্রাব্য ভাষা। আমরা তাঁদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে থাকি।”
কিন্তু বিক্ষোভকারীদের কানে কোনও কথাই পৌঁছয়নি। বনানীদেবী বলেন, “আমাদের চোখের সামনেই স্টাফরুম ভাঙচুর করা হল। লাঠি, রড দিয়ে ভেঙে দেওয়া হল প্রার্থনা কক্ষের সব কাচ। এর মধ্যেই র্যাফ এল। কিছুটা স্বস্তি পেলাম।” বনানীদেবীরা তখন ভাবছেন, এ বার বুঝি বাইরের গণ্ডগোল থামবে। কিন্তু কোথায় কী!
বনানীদেবী বললেন, “এ বার বিপদ এল পিছন থেকে। স্টাফরুমের পিছনের জানলার খড়খড়ির কাঠ ভেঙে দিল কেউ। তার পরেই ওই জানলা থেকে ইটের টুকরো ছুটে আসতে থাকে আমাদের দিকে। বেঞ্চ থেকে নেমে আমরা মাটিতে বসে পড়ে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করি। পুলিশ আর কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চায়নি। আমাদের কোনও মতে স্টাফরুম থেকে বার করে দোতলার একটি
অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।” শুরু হয় আতঙ্কের অন্ধকার প্রহর গণনা।
তার পরে কী ঘটেছে, জানা নেই বনানীদেবীর। তাঁর শুধু মনে আছে, কয়েক ঘণ্টা ঘরে আটকে থাকার পরে পুলিশ দরজা খুলে তাঁদের পাহারা দিয়ে স্কুলের বাইরে নিয়ে আসে।
বনানীদেবীর মতো আতঙ্ক কাটাতে পারেননি বাংলার শিক্ষিকা কুমকুমদেবীও। ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে বেরোনোর আগে তিনি জানতেন না বলে ওই শিক্ষিকার। তিনি বলেন, “সংবাদমাধ্যমে ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর খবর পেয়ে বিষয়টি জানার জন্য ১০টার একটু আগে স্কুলে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু এমন দৃশ্য যে দেখব, তার জন্য কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না।” কুমকুমদেবীর মন্তব্য, “সে-দিন ভাঙচুরের ঘটনায় যে-সব অভিভাবক জড়িত ছিলেন, তাঁদের কয়েক জনকে চিনি। রীতিমতো
চমকে গিয়েছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, এঁরা কারা?”
হঠাৎ এক দল বিক্ষোভকারী ধেয়ে যান অধ্যক্ষার ঘরের দিকে, জানালেন শিক্ষিকা পাপড়িদেবী। বললেন, “আলোচনায় বসতে অনুরোধ করা হল। ওঁরা মানেননি। উল্টে ভাঙচুর শুরু করে দেন। চলল তাণ্ডব।” সে-দিনের ঘটনা কী করে তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায়, প্রাণপণে সেই চেষ্টাই চালাচ্ছেন ওই শিক্ষিকা। |