ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা এখন বর্ষার পর খানাখন্দে ভরা রাস্তার উপর প্রথম প্রলেপ পড়ার পর যে-অবস্থা হয়, অনেকটা সেই রকম। আর এক দফা বর্ষণ হলেই আবার জেগে উঠতে পারে গর্তগুলি। তা না-হলে এবং দ্বিতীয় প্রলেপ পড়লে রাস্তা মসৃণ থাকবে বেশ কিছু দিন। সবার প্রার্থনা এখন পরেরটির জন্য।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন কর্ণধার রঘুরাম রাজন দায়িত্ব নেওয়ার দিন থেকেই ঘুরতে শুরু করেছিল চাকা। সেই কারণে এই পরিবর্তনকে বিভিন্ন মহলে ‘রাজন এফেক্ট’ বলা হচ্ছে। রাজনের সিদ্ধান্ত টাকার দাম বাড়াতে সাহায্য করেছে। এবং তার প্রভাবে শেয়ার বাজারে প্রাণ ফিরেছে, সন্দেহ নেই।
শেয়ার বাজারের মতো অর্থনীতি কিন্তু রাতারাতি ভোল পালটায় না। সময় লাগে। তলানিতে ঠেকার পর দেশি এবং বিদেশি কারণে অর্থনীতি কিন্তু ভিতরে ভিতরে শক্তি সঞ্চয় করছিল। যার ফলে অনেক দিন পর বেড়েছে শিল্পোৎপাদন। ৯ মাস পর বেড়েছে গাড়ি বিক্রি। টাকার দাম কমায় এবং ইউরোপীয় অর্থনীতিতে কিছুটা প্রাণ ফেরায় বেড়েছে রফতানিও।
অন্য দিকে, সোনা আমদানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় কমেছে আমদানির পরিমাণ। পাশাপাশি ভরসা জোগাচ্ছে এ বারের বর্ষা। সব মিলিয়ে আবার সৃষ্টি হয়েছে ভাল লাগার পরিস্থিতি। এই অবস্থায় লাগাতে হবে দ্বিতীয় প্রলেপ।
দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় সরকার কিছু সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে, যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে অর্থনীতির পক্ষে সহায়ক। ১৭টি বড় প্রকল্প, যেগুলিতে মোট লগ্নির পরিমাণ ৪ লক্ষ কোটি টাকা, সেগুলি দ্রুত রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় হাতে নেওয়া হবে ৭টি প্রকল্প, যেখানে লগ্নির পরিমাণ ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা। প্রকল্প রূপায়ণে গতি আনা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতেও। এর ফলে উপকৃত হবে বিভিন্ন শিল্প। বাড়বে কর্মসংস্থান।
জমে থাকা বেশ কয়েকটি বিলও পেশ করা হয়েছে সংসদে। এরই মধ্যে আইনে পরিণত হয়েছে কোম্পানি বিল। পাশ হয়েছে পেনশন বিল। নতুন সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে রফতানির ক্ষেত্রে। অর্থাৎ সরকার বার্তা দিতে চাইছে ‘সংস্কার চলছে’। যে ব্যাপারটি বিদেশি লগ্নি -কারীদের আস্থা বিশেষ ভাবে ফেরাতে পারে, তা হল ভোডাফোন কোম্পানির কর সংক্রান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি। আশা করা যায়, এই ব্যাপারে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ করবে।
মাত্র কয়েক মাস আগেও ক্রমাগত সুদ কমানোর দাবি করে আসছিল শিল্প-বাণিজ্য মহল। বাস্তবে হয়েছে তার উলটো। টাকার দাম কমতে থাকায় প্রকারান্তরে সুদ বাড়াতে হয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে। ফলে সুদ বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের ঋণের উপর।
ব্যাঙ্কগুলিও জমার উপর সুদ বাড়িয়েছে কোনও কোনও মেয়াদে। সম্প্রতি জমার উপর সুদ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে গৃহঋণ সংস্থা এইচডিএফসি। গত বছরের তুলনায় ভাল সুদ দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার করমুক্ত বন্ডেও। অর্থাৎ এখন যাঁরা অবসর নেবেন, বলা যায় সময়টা তাঁদের পক্ষে অনুকূল।
সাধারণত দেখা যায়, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে জিনিসপত্রের দাম। অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়লে দাম কমার প্রবণতা দেখা দেয়। আমাদের দেশে এই ব্যাপারটি কিন্তু একদমই ঘটেনি। বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ থেকে নেমে ৫ শতাংশে চলে আসা সত্ত্বেও খুচরো বাজারে দাম তো কমেইনি, বরং অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। দেশে যে-বিপুল পরিমাণ কালো টাকা ছড়িয়ে আছে, তার প্রভাবেই দাম কমছে না বলে মনে করা হচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মাধ্যমে টাকার জোগানের উপর যতই নিয়ন্ত্রণ আনুক, ছোট বড় অসংখ্য আর্থিক কেলেঙ্কারির ফসল হিসাবে বেআইনি টাকার পরিমাণ কিন্তু বেড়েই চলেছে। এই টাকা দিয়ে বাড়ি, সম্পত্তি অথবা বন্ড কেনা কিংবা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখায় অসুবিধা আছে। এই কারণে এই টাকার একটি বড় অংশ নগদে ব্যবহৃত হয় সোনা কিনতে ও খুচরো পণ্য এবং বিনোদনের বাজারে। যে কারণে মন্দার বাজারেও চাঙ্গা ছিল এই সব বাজার।
সবশেষে আসা যাক শেয়ারের কথায়। সেনসেক্স আবার ২০ হাজারের দোরগোড়ায়। বড় শেয়ারের বেশির ভাগই বেড়েছে। কিন্তু আপনার পোর্টফোলিওতে যদি মাঝারি এবং ছোট শেয়ার থাকে, তবে দেখবেন মোট মূল্য হয়তো বাড়েনি। সূচক অথবা নিজের গোটা পোর্টফোলিওর দিকে না-তাকিয়ে যে যে শেয়ারের দাম বেশ আকর্ষণীয় জায়গায় উঠে এসেছে, তার কিছু কিছু বিক্রি করে লাভ ঘরে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে। বিশ্ব এবং ভারতীয় অর্থনীতির রাস্তায় এখনও কিন্তু চোরা খাদের অভাব নেই। অর্থাৎ চাকা মাঝেমধ্যেই বসে যেতে পারে। সেই সুযোগে বিক্রি করা শেয়ার আবার সস্তায় কেনার সম্ভাবনা থাকবে।
ভাল রকম সাফল্যের সঙ্গে উতরে গিয়েছে আরইসি করমুক্ত বন্ড ইস্যু। আবেদন জমা পড়েছে ৩৫০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বন্ডের জন্য।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাজারে আসছে হাডকোর করমুক্ত বন্ড ইস্যু। ইস্যুর প্রাথমিক আকার ৭৫০ কোটি টাকা হলেও অতিরিক্ত আবেদনের ক্ষেত্রে ইস্যুর আকার বেড়ে ৪৮০৯ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এই ইস্যুর রেটিং এক ধাপ কম হওয়ায় (এএ+) সুদের হার আরইসি-র তুলনায় এক চুল বেশি। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লগ্নির ক্ষেত্রে ১৫ বছর মেয়াদে সুদ পাওয়া যাবে ৮.৭৬%, যা পুরোপুরি করমুক্ত। এর উপর ৩০.৯০% হারে কর চাপালে করযোগ্য সুদের হার দাঁড়ায় ১২.৬৮%। বেশ ভালই বলতে হবে। ইস্যু খোলা আছে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত।
|