স্মরণ ২
বাংলার তিনি কর্ণ
তিনি গদ্যে অর্জুন, কবিতায় যুধিষ্ঠির, কাব্যনাটকে কৃষ্ণ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজেই ছিলেন মহাভারত। একটা আকর গ্রন্থ। তবু তাঁকে কর্ণ মনে হয়। তাঁর রথের চাকা বসেনি, কিন্তু নজরুল, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুভাষ-সুকান্ত সবার চাকা তুলে এনে, তাঁর নিজের চাকা যেন থমকে গিয়েছিল! লিজেন্ড হয়েও তাঁর চোখে জল আরও ভাল কবিতা যে তিনি লিখতেই পারতেন!
আমি বুদ্ধদেব বসুকে চোখে দেখিনি। ১৯৭৪ সালে যখন তিনি মারা যান, আমি তখন কৃষ্ণনগরে ক্লাস ইলেভেন। টাকা ছিল না টিকিট কেটে কলকাতায় আসব। সকালবেলা আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় তাকিয়ে দেখলাম তাঁর শবদেহ চলেছে। কাঁধ লাগিয়েছেন তখনকার তরুণ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমার মনে হল আমি তাঁকে চোখে দেখিনি, কিন্তু আমি তাঁকে দেখেছি। আমি তাঁকে এ বার আরও ভাল করে দেখতে শুরু করব।
দেশলাই ধরালেন। বুড়ো আঙুল এবং তর্জনী শিখা সমেত এগিয়ে আসতে লাগল ঠোঁটে ধরা সিগারেটের দিকে। সিগারেট পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না অগ্নি। সিগারেটের কয়েক ইঞ্চি আগে তর্জনী থেমে গেল। বুদ্ধদেব বসু ঢলে পড়লেন। সামনে খোলা পড়ে থাকল অসমাপ্ত মহাভারত, যেটা তিনি তখনও লিখছিলেন। অগ্নি কি মৃত্যুকেও ভয় পান? লিখতে লিখতে বুদ্ধদেব চলে গেলেন। কোনও লেখকের মৃত্যু এর থেকে সুন্দর আর হয় কখনও?
ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে, আশির দশকে যে দু’জন বাঙালি কবি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিট, তাঁদের একজনের নাম শার্ল ব্যোদলেয়র। আর একজন রাইনের মারিয়া রিলকে। ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে দু’জনকে যে ভাবে সশরীরে ধরে এনে অনুবাদ করেছিলেন, বাঙালি করেছিলেন, তা অভূতপূর্ব। রবীন্দ্রনাথ অজস্র বিদেশি কবিতা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু তিনি কাউকে নিজের জায়গা ছেড়ে দেননি। বুদ্ধদেব নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন, গর্ভগৃহ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেটা কখনও কখনও মনে হয়েছে আত্মহত্যা। নিজের কবিতা বিসর্জন দিয়ে অন্যের কবিতা নিয়ে মাতামাতি করা কি অন্যায়! আসলে আত্মহত্যাও এর থেকে সুন্দর হয় না।
রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসুই হলেন সব চেয়ে বড় আইকন। প্রথমে ছিলেন রবীন্দ্রবিরোধী। ওই বিরোধিতা না থাকলে নিজের লেখা লিখতে পারতেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবন নিয়ে যে লেখা লিখেছিলেন, তা পড়ে চোখে জল আসবে না, এ রকম কোনও বাঙালি নেই। এত বিরোধী ছিলেন যিনি, তিনি এ ভাবে কাঁদিয়ে দিতে পারেন? এর থেকে সুন্দর বিরোধিতাও আর হয় না। ডাঁটাচচ্চড়ি খেয়ে যাঁরা ইংরেজিতে লেখালিখি করেন, তাঁদের সম্পর্কে একটা মারাত্মক কথা বলেছিলেন বুদ্ধদেব। ওঁদের রাস্তাটা ব্লাইন্ড অ্যালি। ওঁদের লেখালিখি হল কিউরিও শপ। মাতৃভাষায় না লিখলে লেখা কখনও সাহিত্য হয়ে ওঠে না। লেখা লেখাই থেকে যায়। কিন্তু গত পঁচিশ বছরে ওঁর কথাটা ক্রমশই মিথ্যে হয়ে, আরও দীর্ঘতর হয়ে সামনে এগিয়ে এল।
সলমন রুশদি, অরুন্ধতী রায়, অমিতাভ ঘোষ, বিক্রম শেঠ এই চার জন প্রমাণ করে দিয়েছেন ইংরেজদের থেকে ওঁরা অনেক ভাল লেখেন এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসে ওঁরাই বেস্ট সেলার্স লিস্টে থাকেন। ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম ডারলিম্পল, যিনি জয়পুর ফেস্টিভ্যালে ‘নেটিভ’ কবি-লেখক বাদ দিয়ে থাকেন, খোঁচা দিয়েছেন অমিতাভদের, ‘দুন স্কুল ডায়াস্পোরা’ দিয়ে সাহিত্য হবে না। ওঁরা ভারত চেনেন না। হরি হরি, ভূতের মুখে রামনাম। এ আবার হয় নাকি? তাহলে অরওয়েল যে ‘ইটন’ থেকে বেরনো প্রোডাক্ট, তিনি কেন ব্রিটিশ ওয়ার্কিং ক্লাস নিয়ে লিখতে গেলেন?
বু.ব. যে তর্কটা ৫০ বছর আগে তুলে দিয়েছিলেন, সেটা এখনও তাহলে জীবিত? সাহিত্যে ‘নেটিভ বনাম নেটিভ’ (ভারতে যাঁরা ইংরেজিতে লেখেন তারা সুপিরিয়র নেটিভ, যাঁরা বাংলা বা তামিলে লেখেন তাঁরা ইনফেরিয়র নেটিভ) এখনও একটা গরম আলু যা হাতে ধরে থাকা যায় না।
জীবনানন্দকে কেউ কবি বলতেই চাইত না, বু.ব যদি ওই লেখা না লিখতেন, জীবনানন্দকে আমরা আবিষ্কার করতে পারতাম কি না সন্দেহ। ঠিক টি এস এলিয়টের মতো। জন ডান চারশ বছর ধুলোর নীচে শুয়েছিলেন। তুলে আনলেন এলিয়ট, এখন জন ডান সারা পৃথিবীতে পাঠ্য। জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতাটিকে তিনি ইয়েটসের ‘ও কারলিউ’ কবিতাটির থেকে অনেক ‘তৃপ্তিকর’ বলেছিলেন। গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করেও বিষ্ণু দে-কে এক হাত নিয়েছিলেন, ‘ক্রতুকৃতম, অপাপবিদ্ধমস্নাবির, সোৎপ্রাসপাশ, এই সব শব্দ ব্যবহার করে সত্যি লাভটা কোথায়?’ সেই লেখাতেই লিখলেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের মারফৎ জানলুম যে আপনার মতো এলিয়ট-ভক্ত কখনও নিছক অন্তঃপ্রেরণার তাড়নে কবিতা লেখেন না। তবে কিসের তাড়নায় লেখেন?’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতে তুলে দিয়ে গেছেন। এখনও ভারতের বহু শহরে তাঁর নামেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চেনে। ওঁর মতো উঁচু মানের শিক্ষক আর হবে না। তাঁর গদ্য পড়ে আজও শিহরন হয়, গর্ব হয় বাংলা ভাষাটা এত ভাল, একটু নমুনা দিই, ‘বহুমুখী গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আছেন একান্ত হ্যেল্ডারালিন ও জীবনানন্দ, মনীষী শেলি ও কোলরিজের পাশে উন্মাদ ব্লেক ও অশিক্ষিত কীটস, উৎসাহী বোদলেয়ারের পরে শীতল ও নিরন্জন মালার্মে।’
এ রকম একটা ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করা লাইনে আধুনিক কবিতার দুশো বছর বলে ফেলা যায়, বাংলায় দ্বিতীয় বার লেখা হয়নি এ রকম মৌলিক পাণ্ডিত্য। এখন যা সব লেখা হয়, সব এখান ওখান থেকে ঝেপে লেখা, বড্ড বেশি ‘বরোড’। বাঙালি এখন বিদ্যাচর্চায় ক্রীতদাস, হাভার্ডে কলম্বিয়ায় মেঘ করলে কলকাতায় বৃষ্টি হয়।
শেষ জীবনের রবীন্দ্রনাথকে যে ভাবে দেখেছিলেন, তাতে ছিল মহাকাব্যের উপাদান। ‘মনে করা যাক দিগ্বিজয়ী একজন রাজা, রাজত্ব রইল, রইল অন্তরের রাজকীয়তা। কিন্তু যে পথ দিয়ে রাজার সঙ্গে রাজত্বের যোগাযোগ, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি প্রেরণা অক্ষুণ্ণ। কিন্তু দেহের যে সামান্য কয়েকটা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া শিল্প প্রকাশিত হতে পারে না, তারা ঘোষণা করেছে অসহযোগ। শ্রবণশক্তি নিস্তেজ, আঙুল দুর্বল, তুলি ধরার মতো জোর নেই, কলমও কেঁপে যায়। তিনি নাকি বলেন ‘বিধাতা মুক্তহস্তেই দিয়েছিলেন, এবার একে একে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।’ এই লেখাতেই লিখেছিলেন, ‘এত সুন্দর বুঝি তিনিও ছিলেন না, এর জন্য এই বয়সের ভার আর রোগ-দুর্ভোগের প্রয়োজন ছিল।’ এই লেখা এখনও চোখ প্লাবিত করে দেয় জলে, কিন্তু জল পড়তে দেয় না। এক জন মাস্টারমশাই, একজন ঔপন্যাসিক, একজন অনুবাদক, ইউরোপ আমেরিকা চষে বেড়ানো প্রাবন্ধিক, এবং সবার উপরে একজন কবি, খণ্ড খণ্ড সত্তা নিয়ে যে অখণ্ড বুদ্ধদেব বসু তিনিই পারতেন এমন করে লিখতে।
পাস্তেরনাককে নিয়ে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি যে খোলা চিঠি লিখেছিলেন সেটি বাংলা ভাষায় লেখা একটি শ্রেষ্ঠতম খোলা চিঠি। কেননা গোপন চিঠিতে রাণুকে লেখা ভানুর চিঠিগুলোই এখনও পর্যন্ত হিরের নাকছাবি। পাস্তেরনাকের ‘ডক্টর জিভাগো’ নিয়ে তখন পৃথিবী তোলপাড়, ইউরোপ জুড়ে ‘আমরা ওরা’। বন্ধু অমিয় চক্রবর্তী লিখলেন পাস্তেরনাকের বিরুদ্ধে, ‘রাত্রে ঘরে বসে ভদকা খেলে কী হবে, ওই মানবত্বহীন অবস্থায় লেখা কবিতার দৌড়ও তথৈবচ।’ বুদ্ধদেব শাণিত অক্ষরে উত্তর দিলেন এই বলে যে, যাঁরা জল ও বিশুদ্ধ গোদুগ্ধ ছাড়া আর কিছুই পান করেন না এবং যাঁরা সুরাসক্ত, উভয় শ্রেণীর মানুষই ভাল এবং খারাপ কবিতা লিখেছেন ও লিখে থাকেন।’
অমিয় বলেছিলেন, ‘জিভাগো লোক ভাল নয়।’ বুদ্ধদেব লিখলেন, শেলির অবিবেচনায় তাঁর প্রথম স্ত্রীকে জলে ডুবে মরতে হয়েছিল, গ্যেটে সজ্ঞানে দদ্ধ করেছিলেন বহু নারীর জীবন, বহুকাল পর্যন্ত রক্ষিতাকে পত্নীর মর্যাদা দেননি। ভাল লোক না হলে ভাল কবিতা লেখা যাবে না কে বলেছে? আপনি যদি জিভাগোর কবিতা ‘স্ববিলাসী’ বলেন আমি চুপ করে থাকব যে রকম চুপ করে থাকি টলস্টয়ের সামনে যখন তিনি বলেন ‘কিং লিয়র’ হাস্যকর এবং অপাঠ্য। দশ পাতার এই চিঠিটি প্রত্যেক লেখকের রোজ এক বার করে পড়া উচিত।
মস্কো থেকে চল্লিশ মিনিট দূরে পাস্তেরনাকের বাড়ি, আরও দূরে একটি কবরখানায় গিয়েছিলাম তাঁর সমাধি দেখতে। সেখানে দাঁড়িয়েও আমি একটা বিকেল জুড়ে পড়ছিলাম বুদ্ধদেব বসুর এই যুগান্তকারী চিঠি।
পাস্তেরনাক জানতে পারলেন না তাঁর হয়ে পৃথিবীতে সব চেয়ে দামি চিঠিটি লিখে রেখে গেলেন একজন বাঙালি কবি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.