শনিবারের নিবন্ধ
উরিব্বাবা
রোমাঞ্চকর কিনা জানি না মশাই, কিন্তু ইদানীং এখানে এক জাঁদরেল সাধুর আবির্ভাব হয়েছে...প্রয়াগ থেকে সোজা সাঁতরে এসেছেন কাশীতে।”- এ হেন মছলিবাবার শেষ পর্যন্ত কোতোয়ালিতে ‘আঁশ ছড়ানো’ হয়েছিল বটে, তবে তাঁর মহিলাঘটিত কোনও কেলেঙ্কারির কথা সত্যজিৎ রায় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ লিখে যাননি। ‘সোনার কেল্লা’য় ভবানন্দ ও তাঁর চেলা মন্দার বোস শিকাগোতে আধ্যাত্মিক চিকিৎসালয় খুলে বিস্তর লোক ঠকালেও সে স্ক্যান্ডালে আর যাই হোক সেক্স-এর নামগন্ধও ছিল না। তাই হালের ‘গডম্যান’ আর ‘পাওয়ার গুরু’দের সঙ্গে মছলিবাবা-ভবানন্দর তফাতটা অনেকটা ফেলুদা আর জেমস বন্ডের ফারাকের মতো, বিস্তর।
গত কয়েক দিনে টাকার অধোগতি বা পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির পাশে শিরোনামে জায়গা করে নেওয়া আশারাম বাপুর কিস্সা দিয়েই শুরু করা যাক। নাতনির বয়সি এক পঞ্চদশবর্ষীয়াকে যৌন হেনস্থা করার অভিযোগে আপাতত তাঁর ঠিকানা যোধপুরের শ্রীঘর। সেখানেই বাপু বায়না জুড়েছেন, রোজ অন্তত দু’ঘণ্টার জন্য তাঁর চিকিৎসার জন্য ‘মহিলা বৈদ্য’র বন্দোবস্ত করতে হবে কর্তৃপক্ষকে! ‘সন্ত’ আশারামকে ঘিরে বিতর্ক কিন্তু নতুন নয়। দিল্লি ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে চরম অসংবেদনশীল বহুচর্চিত মন্তব্যটির কথা বাদই দিন, ২০০৯-এ রাজু চন্দক নামে তাঁর এক শিষ্যকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল আশারামের বিরুদ্ধে। তার এক বছর আগে আমদাবাদ আশ্রমে তাঁর গুরুকুলের দুই ছাত্রের প্রাণহীন দেহ পাওয়া যায় সবরমতী নদীর তীরে। সে বছরই মধ্যপ্রদেশে আশারামের গুরুকুলের শৌচাগারে পরপর দু’দিন চার ও পাঁচ বছরের দুটি ছাত্রের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। এ ছাড়া রাজস্থান, গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশে কোটি কোটি টাকার জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগ তো আছেই।
এত কিছু সত্ত্বেও ভক্তমহলে আশারামের জনপ্রিয়তা কিন্তু এক ছটাক কমেনি। দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ৪০০টি আশ্রম ও ১৭০০০ ‘বাল সংস্কারকেন্দ্র’ চলছে রমরম করে! এ হেন ‘বাপু’-কে নিয়ে কথা হচ্ছিল এবিপি নিউজ-এ আমার এক দশকের সহকর্মী মণীশ শর্মার সঙ্গে। দীর্ঘদিন ধরে আশারাম বাপুর আশ্রমের নানা ঘটনাবলি ‘কভার’ করার অভিজ্ঞতা থেকে মণীশ জানাল এক আশ্চর্য তথ্য। আশারাম বাপুর আশ্রমের অধিকাংশ দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের নাকি আবশ্যিক ভাবে কুৎসিত দর্শন হতে হয় যাতে কোনও শিষ্যার মনোযোগই আশারাম ছাড়া অন্য কারও দিকে আকর্ষিত না হয়! মণীশের মতে এখনও ‘সন্ত’ আশারামের ভাবমূর্তি তাঁর ভক্তদের মাঝে এতটাই অটল যে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের আশ্রমের আশেপাশে দেখলেই তাদের উপর আক্রমণ শানাচ্ছে ভক্তকুল! কিছু দিন আগে একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলের প্রতিনিধিদের প্রহৃত হতে হয়েছে যোধপুরে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে ক্যামেরাও। অর্থাৎ কিনা, ভারতের এই দ্বিতীয় ‘বাপু’র সমর্থকরা অন্তত অহিংসায় বিশ্বাসী নন।
অলংকরণ: সুমন চৌধুরী
স্বঘোষিত ‘গডম্যান’ এবং সংবাদ মাধ্যমের সম্পর্কের কথা উঠলই যখন, প্রথমেই নাম আসবে স্বামী নিত্যানন্দর। নিজেই নিজেকে ‘পরমহংস’ আখ্যা দেওয়া এই নিত্যানন্দর মূল কার্যালয় বেঙ্গালুরুর কাছে। হাজারের বেশি শাখা ছড়িয়ে আছে ৪০টি দেশে! ২০১০-এর ২ মার্চ একটি দক্ষিণী নিউজ চ্যানেল অভিনেত্রী রঞ্জিথার সঙ্গে স্বামী নিত্যানন্দর অস্বস্তিকর মুহূর্তের ভিডিয়ো ফুটেজ সম্প্রচার করে। নিত্যানন্দর অনুগামীরা এই ফুটেজকে জাল বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি জানিয়ে দেয় যে ফুটেজটিতে কোনও কারচুপি নেই। নিত্যানন্দকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং ৫২ দিন গরাদের অন্তরালে কাটাতে হয় স্বঘোষিত ‘পরমহংস’কে। এর পর ২০১২-র জুন মাসে আর্তি রাও নামে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিক নিত্যানন্দর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। এই ঘটনায় আদালতে নিত্যানন্দ আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে এক দিনের জন্য ফের হাজতবাস করতে হয় এবং কর্নাটক সরকার সাময়িক ভাবে তাঁর আশ্রম ‘সিল’ করে দেয়।
আশারাম বাপুকে নিয়ে যখন দেশজোড়া বিতর্ক তখন আর এক ‘গডম্যান’ বাবা মহেন্দ্র গিরি ওরফে টুন্নু বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ২৪ বছরের এক বিবাহিতা মহিলাকে নর্মদা নদীর তীরে তাঁর ‘নীলকণ্ঠ আশ্রম’-এ চার মাস আটকে রেখে ধর্ষণের। অবশেষে ৪ সেপ্টেম্বর বছর পঁয়ষট্টির টুন্নু বাবাকে গ্রেফতার করে মধ্যপ্রদেশ পুলিশ।
বছর সাতেক আগে জব্বলপুরের স্বামী বিকাশানন্দ ওরফে বিকাশ যোশী অবশ্য আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। নাবালিকাদের উপর যৌন অত্যাচার চালানোর অভিযোগে তাঁকে শহরের এক হোটেল থেকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখনও তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন এক কিশোরী সহ তিন মহিলা। তাঁর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত ৬০টি সিডি থেকে স্পষ্ট হয় শুধু বিকৃত যৌনাচারই নয়, স্বামীজি রীতিমতো ব্লু-ফিল্মের ‘কুটির শিল্প’ও চালাতেন। এক সময়ে ভক্ত ও শিষ্যদের চরিত্র সংশোধনের বাণী বিতরণকারী স্বামী বিকাশানন্দর বর্তমান ঠিকানা অবশ্য জব্বলপুর সংশোধনাগার!
‘ইচ্ছাধারী সন্ত’ স্বামী ভীমানন্দ মহারাজ চিত্রকূটওয়ালের কীর্তি অবশ্য সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আশ্রমে রীতিমতো সংগঠিত ভাবে যৌন ব্যবসা চালানোর অভিযোগে তাঁকে এবং দু’জন বিমানসেবিকা সহ ছ’জন মহিলাকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিশ ২০১০ সালে। পুলিশ দাবি করে দ্রুত প্রচুর অর্থ উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সেক্স র্যাকেট চালাতেন এই স্বামীজি! মধ্যপ্রদেশের চিত্রকূট থেকে দিল্লি এসে নেহরুপ্লেসের এক হোটেলের সুরক্ষাকর্মীর কাজ করা ভীমানন্দ এক দশকের মধ্যে আশ্চর্য দক্ষতায় গড়ে তুলেছিলেন জিনস-টি শার্ট আর পনিটেল শোভিত বিশাল এক অনুগামী বাহিনী। এই সন্ন্যাসীর শুধু যে ছ-ছ’টা আলাদা নাম ছিল তাই নয়, দিল্লির বহু সরকারি ফ্ল্যাটে ‘ইচ্ছাধারী বাবা’র ইচ্ছে ও আয়োজনে মধুচক্রের আসর বসত বলেও জানিয়েছে পুলিশ। এই স্বামীজির সঙ্গে আজও বহু প্রভাবশালী সাংসদ ও বিধায়কের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে খবর।
স্বামী ঘুটঘুটানন্দ শুধু রসগোল্লা আর লেডিকেনির হাঁড়িকে যোগসর্পের হাঁড়ি বলে চালাননি, ‘চারমূর্তি’ উপন্যাসের শেষে পুলিশ টেনিদাকে জানিয়েছিল যে স্বামীজির নেতৃত্বেই ছাপা হত জাল নোট। স্বাধীনতার পরের সময়ে সেই রকম আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত স্বামীজিদের তালিকা কার্যত অন্তহীন। যে দেশে গণেশ দুধ খায়, স্বাভাবিক ভাবে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ ‘অবতার’-দের সংখ্যাও অসংখ্য। পি.ভি.নরসিংহ রাও ঘনিষ্ঠ চন্দ্রস্বামী ওরফে নেমিচাঁদ জৈনের বিরুদ্ধে রাজীব গাঁধী হত্যাকাণ্ডের চক্রান্তে যুক্ত থাকার অভিযোগ অবধি উঠেছে। কিন্তু পরিসংখ্যান স্পষ্ট বলছে ইদানীং যৌন অপরাধে অভিযুক্ত ‘গডম্যান’দের সংখ্যাটা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। ঘোর কলিকালে দস্যু রত্নাকররা তবে কি বাল্মীকি নন, বাল্মীকিরাই দস্যু রত্নাকরের চেহারা নিচ্ছেন? স্বামী প্রেমানন্দর কীর্তিকাহিনি শুনলে মনে সে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক।
স্বামী প্রেমানন্দর জন্ম শ্রীলঙ্কায় হলেও তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লি থেকে উত্থান তাঁর। ১৯৮৯ সালের মধ্যেই ভারত ছাড়াও ১৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর ধর্মীয় সংগঠন।  প্রেমানন্দর বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ উঠল নয়ের দশকের শুরুতেই। ১৩ জন আশ্রমবাসিনীকে ধর্ষণের অভিযোগ যা ডাক্তারি পরীক্ষাতেও ধরা পড়ল। এই মহিলাদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা একজনের সন্তানের ডিএনএ টেস্ট করেও প্রমাণিত হল প্রেমানন্দের পিতৃত্ব। সঙ্গে ছিল রবি নামে শ্রীলঙ্কার এক ইঞ্জিনিয়ারকে খুনের অভিযোগও। বিচারে ১৯৯৭-তে দু’টি মামলায় প্রেমানন্দর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০১২-র ২১ ফেব্রুয়ারি জেলেই মৃত্যু হয় কীর্তিমান স্বামী প্রেমানন্দর।
যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে অভিযুক্ত স্বামীজিদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতানেত্রীর ঘনিষ্ঠতার জল্পনাও উঠেছে আকছার। শোনা যায়, স্বামী সদাচারীর যোগাযোগ ছিল খোদ ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে এবং খাস প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যজ্ঞও করেছেন স্বামীজি। পুলিশ এঁকে গ্রেপ্তার করে ২০০৫ সালে। সেই থেকে এখনও যৌন ব্যবসা চালানোর অপরাধে জেল খাটতে হচ্ছে এই স্বঘোষিত ‘অবতার’কে।
আর এক স্বঘোষিত ‘গডম্যান’ স্বামী শ্রদ্ধানন্দকেও এখন গরাদের আড়ালে কারাজীবন ভোগ করতে হচ্ছে নিজের স্ত্রীকে সম্পত্তির লোভে খুন করে বেঙ্গালুরুর বাড়িতেই কবর দেওয়ার অপরাধে। সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮-এ এই মামলায় স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেয়। স্বামীজি নাকি মহীশূরের প্রাক্তন দেওয়ান মির্জা ইসমাইলের কন্যা ও ভারতের এক প্রাক্তন হাই কমিশনারের প্রাক্তন স্ত্রী শাকিরাকে তাঁর বিপুল সম্পত্তির লোভেই বিয়ে করেছিলেন।
এ ছাড়াও বিশ্বখ্যাত ভারতীয় ‘গডম্যান’দের মধ্যে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে কেরলের স্বামী জ্ঞানচৈতন্যকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। ২২ বছরের এক বিদেশিনিকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল রাধামাধব সোসাইটির প্রধান কৃপালু মহারাজের বিরুদ্ধে। ২০০২-এ বাবা গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। ২০০৫-এ ভক্তিস্বরূপ স্বামীনারায়ণ মন্দিরের পুরোহিতকে যৌন কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে জুনাগড় পুলিশ। আবার ২০০৯-এ চেন্নাইয়ের মাচাইসা পেরুমল মন্দিরের কাঞ্চিপুরম দেবনাথনকে শিষ্যাদের উপর যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হতে হয়।
সুতরাং, ৭৫ বছর বয়সি আশারাম বাপুর বিরুদ্ধে ওঠা যৌন অভিযোগ শুনে যাঁরা ‘গেল-গেল’ রব তুলছেন, তাঁদের হাল আমলের এই কুল-গুরুদের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই নিশ্চয়ই। আসলে পরশুরামের গল্পের জগন্নাথ-ঘাটের সেই লঙ্কাখেকো মিরচাই বাবা কিংবা টিকি থেকে আঠারো ইঞ্চি স্পার্ক ঝাড়া রাজশাহির তড়িতানন্দ ঠাকুরের নিরামিষ জমানা আর নেই।
২০১৩-তে বসে লিখলে রাজশেখর বসু নির্ঘাত দেখাতেন যে দমদমায় আলিপুরের উকিল গুরুপদবাবুকে ঠকিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তাঁর কন্যা বুঁচকির হাত ধরেও টানাটানি করছেন বিরিঞ্চি বাবা!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.