স্মরণ ১
কেবলই ছবি...
সালটা ১৯৭৫ কী ৭৬। কোনও এক সিনেমার শ্যুটিং। দৃশ্যটা ছিল সেটে বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে যাবেন উত্তমকুমার। শটটা টেক হল। উত্তমকুমার এসে আমার সামনের চেয়ারটায় বসলেন। পকেট থেকে একটা সরবিট্রেট ট্যাবলেট বের করে জিভের তলায় দিলেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। খুব অবসন্ন লাগছিল ওঁকে।
সঙ্গী ফোটোগ্রাফার, জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদা, শরীর খারাপ?’ মহানায়ক হেসে বললেন, ‘ও কিছু না মাস্টার, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি, একটু টায়ার্ড লাগছে। আমাকে মাস্টার বলেই ডাকতেন।”
বলছিলেন সে দিনের সেই ‘মাস্টার’, পরিচিত আলোকচিত্রী সুকুমার রায়।
পুরনো দিনের কয়েকটি সিনেমাপত্রিকার জন্য কাজ করতে গিয়েই উত্তমকুমারের ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন সুকুমার রায়। ছবি তুলতে তুলতেই বুঝতে পেরেছিলেন আর পাঁচজন অভিনেতার থেকে এ মানুষটা ছবি তোলার সময়ও একেবারে আলাদা। বুঝেছিলেন, পরদায় যেমন, পরদার বাইরেও সারা ক্ষণ আত্মবিশ্বাসে ঝলমল করতেন উত্তমকুমার।
সাহেবগঞ্জে। ‘জতুগৃহ’র শ্যুটিং-এর ফাঁকে
ছবি তুলতে গেলে কখনও বাধা দেননি উত্তমবাবু? “না, না। কখনও না। একদিনও বলতে শুনিনি, দাঁড়ান, একটু গোছগাছ করে আসি। অবলীলায় পোজ দিতেন। আর ওই ভুবনভোলানো হাসিটুকুই যে কোনও ছবিকে দাঁড় করিয়ে দিত। তবে আমি বরাবর চেয়েছি তাঁর ওই চেনা হাসির বাইরে গিয়ে ছবি তুলতে। তার জন্য সুযোগ খুঁজতে হত। খুব ছোট্ট ছোট্ট বিষয়েও ফোটোগ্রাফারের জন্য মুহূর্ত তৈরি করতে পারতেন উত্তমবাবু। হয়তো বা আলতো হাত চালিয়ে চুলটা একটু ঠিক করে নিলেন, ব্যস ওইটুকুই। ওরই মধ্যে একটা শটের জন্ম হয়ে যেত। যদি সেটা ধরতে পারলেন তো একটা দারুণ ছবি হয়ে গেল।’’ নিজের ক্যামেরায় উত্তম-স্মৃতি বলছিলেন সুকুমারবাবু।
কিন্তু সব সময়ই যে ছবি তোলার সময় পোজ দিতেন তা কিন্তু নয়। তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’-এর শ্যুটিং চলছে সাহেবগঞ্জে। সে দিনের গল্প শোনালেন সুকুমারবাবু, “তত দিনে আমি তপন সিংহের ফোটোগ্রাফার হয়ে গিয়েছি। কিন্তু সাহেবগঞ্জে গিয়ে উত্তমবাবু বলে দিলেন, মাস্টার, এখানে আর পোজটোজ দিতে পারব না। যেমন পারো তুলে নিয়ো। আমি তখন ওঁকে অনুসরণ করতাম শ্যুটিংয়ের ফাঁকে। একা একা নিজের মতো ঘুরে বেড়াতেন।” সে ভাবেই ওই ছবিটা পাওয়া। জাহাজের ডেকের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উত্তমকুমার। ঠোঁটে সেই অদ্বিতীয় ভঙ্গিতে সিগারেটটি ধরা।

‘নায়ক’-এর জন্য পুরস্কার নিতে বিদেশযাত্রা

বিভূতি লাহার একটি ছবিতে।
“আসলে, কাজটাকে এত ভালবাসতেন যে কাজের মধ্যে ডুবে থাকা অবস্থাতেই ওঁর ছবি সব চেয়ে ভাল হত,” বলছিলেন সুকুমারবাবু, “এক বার ওঁর অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম। লিখে দিয়েছিলেন, ‘কথা নয় কাজ, ঘোষণা নয় সাধনা’। নিজে কাজ এত ভালবাসতেন বলেই বোধ হয় সিনেমার সব কর্মীকেই সম্মান করতেন। ড্রেসারের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে নিয়ে ধরাচ্ছেন এমনও দেখেছি।”
আর নার্গিস ও উত্তমকুমারের ছবিটা? “তখন কলকাতায় গভর্নর’স ফ্লাড রিলিফে একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ওঁরা। গ্রিনরুমে গল্প করছিলেন নার্গিস ও উত্তমকুমার। আমাকে দেখেই উত্তমবাবু বললেন, “মাস্টার, এখানেও! আমি বললাম, উপায় কী, আপনি যেখানে, আমিও সেখানে। হেসে ফেললেন।”
শুধু পোজ দেওয়া নয়, একটা বিশেষ দৃষ্টিতে উনি বরাবর ক্যামেরার দিকে তাকাতেন। পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’ ছবির জন্য মেকআপ টেস্ট হচ্ছে। তার সাক্ষী আর এক প্রবীণ আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ। বলছিলেন, “পার্থ মেকআপ টেস্ট মুভিতে নেয়নি, স্টিল-এ নিয়েছিল। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল স্টিল তুলতে। নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে মেকআপ নেওয়ার পর যখন স্টিলের জন্য তৈরি হচ্ছেন দেখলাম যেভাবে ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছেন, তাতে মনে হয় আমার লেন্স যেন ওঁর আয়না। আর দেখলাম অসম্ভব একটা ক্যামেরা সেন্স ওঁর, কখন কী ভাবে লাইটটা নিতে হয় সবই যেন নখদর্পণে।”

শটের আগে উত্তরবঙ্গের বন্যাত্রাণের অনুষ্ঠানে পঙ্কজ মল্লিকের স্নেহ

বাড়ির লক্ষ্মীপুজোয় মা ও ভাইয়ের সঙ্গে
সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে স্থিরচিত্রের কাজ করার সূত্রে আর একটা কথা বলছেন আলোকচিত্রী সৌম্যেন্দু রায়, “কাজ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম কী অসম্ভব ধৈর্য ওঁর। ছবি তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখলেও কখনও বিরক্ত হতেন না। তবে এমন ভাববেন না, সেটা শুধু সত্যজিৎ রায়ের ছবি বলেই। রবি ঘোষের ‘নিধিরাম সর্দার’-এর সময়ও দেখেছি একই ভাবে সিটিং দিচ্ছেন।”
আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষের বেশি পরিচিতি সত্যজিৎ রায়ের ‘ফোটোবায়োগ্রাফার’ হিসেবেই। “কিন্তু মানিকদায় বিভোর থাকলেও ফাঁকে ফাঁকে নাটকের ছবি তুলেছি অনেক, উত্তমবাবুরও,” বলছিলেন নিমাইবাবু।
উত্তমকুমারের গিরীশ মুখার্জি রোডের বাড়ি থেকে সামান্য দূরত্বে কালীঘাট রোডেই বরাবরের বাস ওঁর। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বললেন, “বুড়ো, মানে ওঁর ভাই তরুণকুমার ছিল আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে নাটক-টাটক দেখতে যেতাম। আমি নিজেও তখন নাটক করি...সেই নাটকের ছবিগুলো দেখেই আমার কাজ নিয়ে একটা কৌতূহলও তৈরি হল উত্তমবাবুর। দেখা হলেই বলতেন, ব্যাগের মধ্যে কী ম্যাজিক আছে দেখান তো। তার পরে মেকআপ রুমে নিয়ে গিয়ে শুধু ওঁর নয়, আমার তোলা অন্যের ছবিও দেখতেন।”

যখন ‘বনপলাশীর পদাবলী’র পরিচালক

সোমার বিয়েতে
উত্তমকুমারকে কখনও ছবি তুলতে দেখেননি? “না, আমি যে সময় থেকে ওঁকে দেখেছি তখন ওঁর হাতে ক্যামেরা কখনও দেখিনি।” তবে, ইতিহাস বলছে, পুরনো দিনের একটি সিনেমাপত্রিকায় ক্যামেরা-চোখে উত্তমকুমারের ছবি ছাপা হয়েছিল। পুরস্কার নিতে দিল্লি গিয়ে কোনও স্থাপত্যের ছবি তুলছিলেন উত্তমকুমার। আর, ‘উত্তর ফাল্গুনী’র সময় নিজের ক্যামেরায় সুচিত্রা সেনেরও বেশ কয়েকটি ছবি তুলেছিলেন মহানায়ক!
অভিনয় আর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দু’টোকে কী করে ট্যাকল করতেন উত্তমকুমার? “অভিনয়ের সময় কোনও কিছু মাথায় রাখতেন না। ব্যক্তিগত বা স্টুডিয়োর বাইরের জীবনে যা কিছু ঘটছে তা থেকে পুরো নির্লিপ্ত হয়ে অভিনয়ে ঢুকে যেতেন। আর চরিত্রটার মধ্যে ঢুকে পড়ার কাজটা শুরু হয়ে যেত মেকআপ টেস্টের সময়ই। যেমন, রবিদা যখন ‘নিধিরাম সর্দার’ করার জন্য উত্তমবাবুর কাছে গেলেন, উনি মেকআপ টেস্টের জন্য রাজিও হয়ে গেলেন। আর সেটা তোলার সময় দিব্যি খালি গা হয়ে গেলেন আমার সামনে। তিন নম্বর ময়রা স্ট্রিটে ওঁর ফ্ল্যাটে।”
সোমাদেবীর বিয়ের সময়ও তো আপনিই ছবি তুলেছিলেন? বলতেই জানালেন, “হ্যাঁ, ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে একমাত্র আমাকেই আনুষ্ঠানিক নেমন্তন্ন করেছিলেন। নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে দেখি চিরাচরিত প্রথায় কন্যাসম্প্রদান করতে বসেছেন। ছবি তুললাম অনেকগুলো। তার পরে খাওয়াদাওয়ার সময় নানা অভিনেতার ছবি তুলছি, হঠাৎ পাশে এসে বললেন, ও সব পরে হবে, আগে খেয়ে নাও। এই সূত্রে বলি, পরে সোমাদেবীর বিয়ে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। প্রমাণস্বরূপ ছবিগুলো ছিল আমারই তোলা। কিন্তু আমি সেগুলোকে কোনও দিন আইন-আদালতের সামনে আসতে দিইনি। বলেছিলাম, সে সব নেই আমার কাছে। ইচ্ছে করেই বলেছিলাম।”
অনুষ্ঠানের দিন। গ্রিন রুম। নার্গিসের সঙ্গে
জীবনের নানা বিতর্কে কিছুটা যেন ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ আর এক উত্তমকুমারকে তাঁর জীবনের শেষ দশকে ক্যামেরার চোখে দেখেছেন আলোকচিত্রী পাহাড়ি রায়চৌধুরী। তাঁর সংগ্রহের ছবিগুলো সামনে রেখে ফিরে গেলেন ষাটের দশকে। “আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। উত্তমকুমারের ছবি এলেই দেখতে যেতাম। কিন্তু উত্তমকুমারকে কাছ থেকে দেখার স্বপ্নটা ছিলই। একদিন সহপাঠী অমল চক্রবর্তীর সঙ্গে চলে গেলাম টালিগঞ্জে ‘মায়ামৃগ’-র শ্যুটিং দেখতে। লুকিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম। সেই প্রথম চোখের দেখা। তার পরে পরিচালক চিত্ত বসু এসে খুব বকা দিলেন। খুব দুঃখ হয়েছিল সে দিন। বছর পাঁচেক পরে তরুণ মজুমদারের সহকারী পরিচালক অর্ধেন্দু রায়, যিনি আমার আত্মীয়, সুযোগ করে দিল টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়ায় ফোটোগ্রাফি করার। তার পরে অনেক বার উত্তমকুমারের ছবি তুলেছি। কিন্তু ওঁকে বড় অন্য রকম লেগেছিল বিভিন্ন জলসায়, ফাটাকেষ্ট ওরফে কৃষ্ণচন্দ্র দত্তের কালীপুজোয়। ওঁর সঙ্গে আসতেন জহর রায়। কৃষ্ণচন্দ্র দত্তর পাড়াতেই থাকতাম আমি, সেই সূত্রেই আলাপ।”

তুলির সঙ্গে মজা

বাড়িতে গৌতমের আদর, সামনে গৌরীদেবী
সেটা সত্তরের দশক। আর আজ এই ২০১৩। বদলে গিয়েছে, বদলে যাচ্ছে বাঙালির যৌবন। সাড়ে চুয়াত্তর ছবির গানের সেই চম্পা চামেলি বন... আর বাঙালির যৌবন নয়। উত্তমকুমারও সরে আসছেন চিরপরিচিত হাসিমাখা সেই নায়কের ভূমিকা ছেড়ে চরিত্রাভিনেতার ভূমিকায়। তাই কি তখনকার ছবিতে ধরা পড়েছিলেন এক অন্য মুহূর্তের উত্তম?
সাদা-কালো জীবনের উত্তম!
সোমার মেয়ে তুলির জন্মদিন

ওঁরা বললেন
ছবি তোলার ব্যাপারে উনি খুব চুজি ছিলেন। পছন্দ করতেন যে ফোটোগ্রাফারকে তাঁকেই বাড়িতে এসে ছবি তুলতে দিয়েছেন। কিন্তু সাজগোজ করে এসে যে ছবি তুলতেন এমন নয়। ছবি তোলানোর সময় বলতেন যেমন আছি তেমনি নাও। সবটাই অবশ্য নির্ভর করত মুডের ওপর। মেজাজ খারাপ থাকলে কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। নিমাইদা, মানে নিমাই ঘোষকে অবশ্য খুব স্নেহ করতেন। অনেক ছবি তুলতে দিয়েছেন ওঁকে ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে।
সুপ্রিয়া দেবী
অসম্ভব রাশভারী মানুষ ছিলেন তো, তাই যখন- তখন ওঁর ছবি তোলার কোনও প্রশ্নই উঠত না। বিশেষ করে সেটে বা শ্যুটিংয়ের সময় কাজের মধ্যে এতটাই ডুবে থাকতেন যে সিনেমার স্টিল ফোটোগ্রাফারের বাইরে কাউকে ক্যামেরা নিয়ে সচরাচর ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতেন না। আর তখন সময়টা ছিল অন্য রকম। মহানায়ককে ছবি তোলার জন্য বিরক্ত করবেন এমন সাধ্য ছিল কোন ফোটোগ্রাফারের! তবে কাউকে কাউকে বিশেষ স্নেহ করতেন। মেজাজ ভাল থাকলে তাঁদের অনেক ছবি তুলতে দিয়েছেন।
মাধবী মুখোপাধ্যায়

সোমার বিয়ে, তুলির জন্মদিন ও খাবার টেবিলে উত্তমের ছবি নিমাই ঘোষের। বাকি ছবি: সুকুমার রায়


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.