|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
‘পদ্মবন শেষে বেত্রবনই হতে বাধ্য’ |
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিত্যপ্রিয় ঘোষের ১৯৭৭-২০১১ পর্যন্ত বাংলায় লেখা প্রবন্ধাদি, অধিকাংশই একদা গ্রন্থিত, দু’খণ্ডে প্রকাশ করেছে গাঙচিল বিষয়: রবীন্দ্রনাথ/ নিত্যপ্রিয় ঘোষের প্রবন্ধসংগ্রহ (প্রতি খণ্ড ৫০০.০০)। সমসাময়িক মনীষীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বিশ্লেষণ, বিদেশভ্রমণের সময় তাঁকে ঘিরে যে বিতর্ক, বা মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিতে তাঁকে নিয়ে আলোচনাই প্রধানত উঠে এসেছে নিত্যপ্রিয়র কলমে। এ ছাড়াও কবির স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদ, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিবেদিতা-ওকাম্পো-রাণুর সম্পর্ক সংক্রান্ত আলোচনা যেমন আছে, তেমনই আছে ডাকঘর-মুক্তধারা-রক্তকরবী নাট্যাদির মঞ্চায়নের সমস্যা নিয়ে আলোচনা। রয়েছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘকালীন চিন্তার রূপরেখাও। প্রকাশকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে: ‘এই প্রবন্ধগুলো সমসাময়িক পাঠককে বিরক্ত, উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ যেমন করেছিল, রবীন্দ্রভাবনার একটি নতুন দিকও দেখা গিয়েছিল।’
প্রকাশকের কথাগুলিকে একটু উল্টে নিয়ে বলা যেতে পারে যে, নিত্যপ্রিয়র কলমে কবি সম্পর্কে নতুন ভাবনা এতটাই ধারালো বা প্রখর ছিল যে, পাঠকের প্রতিক্রিয়ায় বিরক্তি উত্তেজনা ক্রোধের প্রকাশ দেখা গিয়েছিল... এ তো স্বাস্থ্যের লক্ষণ! ভারতে স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ-সহ আবিশ্ব বাঙালির মধ্যে বড় বেশি রবীন্দ্রভক্তি, তাতে যুক্তি-বুদ্ধির চাইতেও অন্ধ আবেগের প্রাদুর্ভাব। ঠিক এর বিপ্রতীপ চলন নিত্যপ্রিয়র কলমে। প্রায় নৈয়ায়িকের দক্ষতায় তিনি তর্ক তোলেন, তাঁর একটা রচনাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে তিনি তথ্যানুগ ও বুদ্ধিমার্গী নন। শাণিত যুক্তির সঙ্গে থাকে অনন্য রসবোধ, যা তাঁর গদ্যে এনে দেয় স্বাদুতা। |
|
প্রথম খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে একটি প্রবন্ধ ‘সরল মানবত্বে কোন্ রাষ্ট্রতন্ত্র’। তাতে তথ্য-যুক্তি পেশের পর নিজের মত জানাচ্ছেন নিত্যপ্রিয়: ‘রবীন্দ্রনাথ বলতে ভালোবাসতেন, পল্লীতে দেখা সাধারণ মানুষ ফুটে উঠেছে তাঁর ছোট গল্পে। সত্যি কি তাই। যে বোষ্টমীর কথা তিনি লিখেছিলেন ‘বোষ্টমী’ গল্পে, যে বোষ্টমীর কথা তিনি পরবর্তী জীবনে অনেকবারই বলেছিলেন, সেই বোষ্টমীই কি ফুটে উঠেছে তাঁর গল্পে? তিনি নিজেই পরে বলেছেন, তাঁর চোখে দেখা বোষ্টমী আর গল্পে বলা বোষ্টমী ঠিক এক নয়।’ প্রবন্ধটির প্রায় শেষে লিখছেন নিত্যপ্রিয়: ‘শিলাইদহের স্মৃতি, জমিদারির স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথের কাছে এই স্বচ্ছ সরলতার স্মৃতি। তাই হয়তো পরিণত বয়সে ছোটোগল্প রচনার কথা মনে করতে গিয়ে তাঁর স্মৃতিতে এসেছিল এই সহজ সরল মানুষগুলো, ‘সরল মানবত্ব’। কিন্তু তিনি যদি পুরনো গল্পগুলোর দিকে চোখ দিতেন, দেখতে পেতেন ‘শাস্তি’ গল্প ছাড়া আর কোনো গল্পে এই নিঃসহায় নিরুপায় নিতান্ত নির্ভরপর সরল চাষাভুষোরা নেই।’
আবার দ্বিতীয় খণ্ডে একটি প্রবন্ধ ‘পদ্মবন থেকে বেত্রবন’। পরিসংখ্যান-তথ্য-যুক্তিবাহিত নিত্যপ্রিয় উপসংহারে পৌঁছচ্ছেন: ‘রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের পর শান্তিনিকেতন রবীন্দ্র-আদর্শ থেকে বিচ্যুত এই ধারণার কোনও ভিত আছে বলে মনে হয় না তাঁর নিজের আদর্শ থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ক্রমাগত বিচ্যুত হয়েছিলেন। আর হতে বাধ্য, কেননা তাঁর আদর্শ ছিল ইউটোপিয়ার। অভিভাবকরা তাঁর তপোবনকে বোর্ডিং স্কুল বলেই গণ্য করতেন। পদ্মবন শেষ পর্যন্ত বেত্রবনই হতে বাধ্য, কারণ ডিগ্রি অর্জনের আওতার বাইরে শান্তিনিকেতন যেতে পারেনি। আর ডিগ্রি অর্জনে মুখস্থবিদ্যা যে সেরা বিদ্যা সেটা কে না জানে, একশো বছর আগে যা ছিল ভারতে, এখনও তাই আছে।’
অন্য দিকে অনুত্তম ভট্টাচার্যের কাছে ‘বিশ্বের বিস্ময় রবীন্দ্রনাথ। শুধু সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় রাবীন্দ্রিকতা নয়, তাঁকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তার অন্ত নেই।’ এরই প্রকাশ একগুচ্ছ প্রবন্ধে রামধনু রং/ রবীন্দ্রনাথ (গাঙচিল, ৩৫০.০০)। বইটিতে তিনি নানা দিক থেকে নিরীক্ষণ করেছেন কবিকে। যেমন একটি রচনা, ‘আহা, এমন প্রজা আমি দেখিনি’-তে লিখছেন: ‘‘ছিদ্রান্বেষীরা যতই রবীন্দ্রনাথের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করার প্রয়াস করুন না কেন, রবীন্দ্রনাথই জমিদাররূপে বেশ কয়েক দশক ধরে পল্লি বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন এবং সেই সব খেটে-খাওয়া মানুষদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আত্মিক সম্বন্ধ স্থাপন করে চলেছিলেন। তিনিই প্রথম হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এক ভারতবর্ষের দুই সত্তা গ্রাম-ভারতবর্ষ ও নাগরিক ভারতবর্ষ।... বলেছিলেন: ‘...যখন আমি পদ্মানদীর তীরে গিয়ে বাস করেছিলাম, তখন গ্রামের লোকদের অভাব অভিযোগ এবং কতবড়ো অভাগা যে তারা, তা নিত্য চোখের সম্মুখে দেখে আমার হৃদয়ে একটা বেদনা জেগেছিল। এইসব গ্রামবাসীরা যে কত অসহায় তা আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলাম।’ |
|
|
|
|
|