পুস্তক পরিচয় ১...
কী ভাবে পৌঁছলাম অবিশ্বাস্য বাস্তবে
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় রিডার, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। ওয়ার্ল্ডভিউ, মূল্য অনুল্লেখিত
মরা যা জানতে চাইছি, সেইটা কোথাও এক উঁচু জায়গায় জমে আছে। কোনও এক আলোকিত জ্ঞানভাণ্ডে। আর প্রবাহের মতো নেমে আসছে নীচে। এই রকম একটা ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়েই কি অনেক সময় গড়ে ওঠে আমাদের জানার বোধ? ঠিক সেই কারণেই আমাদের বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলো ধরা পড়ে না তাদের নিজস্ব বাস্তবে। জানা বোঝার গড়ন তৈরি হয়ে ওঠে আগে থেকে। আমরা পৌঁছতে পারি না বর্তমানে। জানার ধারাবাহিকে হারিয়ে যায় দ্রুত অপস্রিয়মাণ, অদৃশ্য এই ক্ষণ। কথাটা প্রায় এক যুগ আগে তুলেছিলেন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, ছোট এক আলোচনাসভায়। সেই সভার নথিপত্র এতদিনে গায়েব হয়ে গেছে। কিন্তু গত বারো বছরে তিনি সযত্নে তৈরি করেছেন আলোচ্য এই বইটি। যেখানে প্রায় ডিটেকটিভ উপন্যাসের মতো পরতে পরতে সাজানো দুরূহ এক তত্ত্বায়ন। আমাদের বোঝা-পড়ার আয়োজনগুলোকেই সম্পূর্ণ নতুন করে ঢেলে সেজেছেন তিনি। খুঁজে দেখতে চেয়েছেন অপরাধটা ঘটছে ঠিক কোথায়। হাজির করেছেন এমন সব অভিজ্ঞান, যা হাতে নিলে ভুলে যাওয়ার উপায় নেই কী বিচিত্র ছলনা-জালে জড়িয়ে আছে আমাদের বাস্তব। এই আমাদের দেশ!
সারা জীবনের কাজ থেকে নানা অংশ তুলে নিয়ে সাধারণত তৈরি হয় ‘রিডার’। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটি তেমন নয়। সংকলনের আটটি প্রবন্ধের সাতটিই গত দশ বছরে লেখা। বিষয় বহুমুখে ছড়ানো। এই রকম সংকলনে যথাযোগ্য ভূমিকা থাকা দরকার। র্যাকস মিডিয়া কালেক্টিভের ত্রয়ী সে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মনে হল না। এক দিক থেকে দেখলে এই সংকলন লেখকের সারা জীবনের কাজ আর অভিনিবেশের ভেতর থেকে উঠে আসা। আর অন্য দিকে বইটি ‘রিডার’ শব্দটিকেই বেশ গোলমালে ফেলে দেয়।
প্রচ্ছদে সাদামাটা এই পদ সাজানো আছে ধাপে ধাপে। অভ্যস্ত সহজ পাঠ শেষ করে কেউ যদি উল্টো মুখে ঘুরে দাঁড়ান, শেষ অক্ষর থেকে সর্পিল পথে ফিরে আসেন প্রথমে পৌঁছবেন একই পদবন্ধে। পড়ার অভ্যেসটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়াই এই লেখকের অন্বিষ্ট। পাঠক কখন লেখকের কাছে পৌঁছতে চাইছেন আর লেখকই বা কী ভাবে হয়ে উঠছেন পাঠক এই অস্থির উভমুখ চলাচলেই বাঁধা আছে বিচিত্র এই সমাবেশ। প্রায় অসম্ভব হলেও ছোট্ট একটু পরিচয় দেওয়া দরকার কতখানি বহুমুখী এই সংকলন। এখানে রয়েছে ‘অদ্বৈতবাদ আর জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে এক অসামান্য সমীক্ষা। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ডন’ পত্রিকা আর ডন সোসাইটি-র মুখপত্রকে সামনে রেখে শিবাজী দেখিয়েছেন ‘যুক্তি’, ‘ভক্তি’, ‘হিন্দুত্ব’ আর স্বাদেশিকতার কতখানি প্রমাদ জমে উঠেছে আমাদের অতীত মুদ্রায়।
আর এই সংগঠিত ঐতিহাসিক অতীত নিয়েই হাজির হয়েছে ‘বিস্মৃতির ওপর এক স্মরণিকা’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এক ইনস্টলেশন-এর পরিকল্পনা করেন শিল্পী ভিভান সুন্দরম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। সেই প্রদর্শনী-র মুখবন্ধ ছিল এই লেখাটি। উপনিবেশের স্মৃতিসৌধে কী ভাবে উপস্থিত হয় বিস্মৃতির ক্রমপরম্পরা, গর-হাজির যত স্মৃতিচিহ্ন তার বর্ণনা রয়েছে এখানে। ঔপনিবেশিকতা আর তার ছেঁড়া-খোঁড়া বাস্তবের আবিশ্ব ভ্রমণরেখা বরাবর শিবাজী তুলে এনেছেন ইতিহাসের লুকনো সব দীর্ঘশ্বাস। যাঁরা প্রদর্শনীটি দেখেননি, পরবর্তী সংস্করণে তাঁদের জন্য প্রকাশক কি কয়েকটি ফোটোগ্রাফ তুলে দিতে পারেন? ইনস্টলেশনের মর্যাদা হানি হবে তাতে, তবু।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবি থেকে একটি আশ্চর্য মুহূর্ত তুলে নিয়েছেন লেখক, ‘রায়ের স্মরণক্রীড়া’ লেখাটিতে। চার বাঙালি যুবক আর দুই যুবতী যেখানে নেমে পড়েছেন ‘মেমরি গেম’ নামক সুসভ্য খেলায়। যেখানে নামোল্লেখ-এর পরম্পরা আর বিস্মরণ কিছুতেই পৌঁছতে দেয় না কোনও নাম-মাহাত্ম্যে। অতীত নামক ধারাবাহিক কারবারটাই ভেস্তে যায়। ধরা পড়ে চৈতন্যের নানা ফাঁক-ফোকর।
এই মনে করতে চাওয়া বা স্মরণ-উদ্যোগ কতখানি জটিল হয়ে উঠতে পারে, সেই দিকে শিবাজী ইঙ্গিত করেছেন ঋত্বিক ঘটকের ছবি নিয়ে তাঁর আলোচনায়। মূল বাংলা লেখাটি রয়েছে শিবাজীর বাংলা প্রবন্ধ সংকলন আলিবাবার গুপ্ত ভাণ্ডার-এ। এখানে রয়েছে ইংরেজি অনুবাদ।
এই সব প্রবন্ধে শিবাজী কখনও তুলে নিয়েছেন একটি অভিজ্ঞা বা ধারণা, সবিস্তার বুঝে নিচ্ছেন কী ভাবে তার ভেতর জমে আছে হাজার মুহূর্ত। আর কখনও বেছে নিচ্ছেন তীব্র এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত যেখানে অজস্র অতীত অভিজ্ঞার অভ্যাস টের পাওয়া যায়। এই রকমই এক লহমা নিয়েই বইটিতে এসেছে মীরা নায়ার-এর ‘ফায়ার’ ছবিটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা তাণ্ডবের পূর্বপাঠ। আর ‘সন্ত্রাস’ বা ‘টেরর’ নামক ধারণাটাকে নিয়ে শিবাজী হাজির করেছেন ‘সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়ন: একটি ফ্রয়েডীয় কসরৎ’। দুটি লেখাই এক কথায় অনবদ্য।
বিস্মরণ থেকে সন্ত্রাস পর্যন্ত এই অভিযাত্রায় শিবাজীর মূল লক্ষ্য ‘ইডিয়োলজি’ বা মতাদর্শ। বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক। জার্মান ইডিয়োলজি বইটিতে মার্কসীয় ব্যাখ্যায় আর ফরাসি তাত্ত্বিক লুই আলথুসের-এর তত্ত্বায়নে ‘মতাদর্শ’ মানেই শাসক শ্রেণির মতাদর্শ। যা রাষ্ট্রযন্ত্রে বাইরে থেকে চেপে না-বসে ভেতর থেকে কথা শোনে। অনেকটা সেই পুরাণকথার ‘বাতাপী’ রাক্ষসের মতো। এই মতাদর্শ অনেকটা কুয়াশার ঢঙে নেমে আসে চার দিক থেকে। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে সম্পূর্ণ কাল্পনিক কায়দায় হাজির করে। লোপাট হয়ে যায় অজস্র ফাঁক-ফোকর, অসঙ্গতি, প্রশ্ন আর পরিপ্রশ্ন। তৈরি হয় ধারাবাহিক এক প্রবাহ। যাকে আমরা ইতিহাস বলে থাকি। যাকে আমরা চেতনা বলে থাকি।
শিবাজীর এই সমীক্ষণ মূলত বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত পুরুষের মতাদর্শ বরাবর চূড়ান্ত আক্রমণ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের বাস্তবে আরও অনেক মতাদর্শের উপস্থিতি রয়েছে, যা বাদ গেলে আমাদের পরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেই সব বয়ান যতই থিতিয়ে পড়া হোক, তাদের সংঘর্ষেই তো বিবদমান আমাদের বাস্তব। সেই কুহকের বাকি ইতিহাস জানার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতিহাস মানুষ বানায়, কিন্তু যেমন খুশি বানাতে পারে না। এক-একটা বিকট মুহূর্ত যখন উঠে দাঁড়ায়, তার নীচে চাপা পড়ে যায় মানুষ। অনেক অগণ্য সাধারণ মানুষ। একটা প্রশ্ন তখন চারিয়ে যায়, কাকে বলে কাজ? কাকে বলে সময়ের মুখোমুখি দাঁড়ানো? ইংরেজিতে ‘অ্যাক্ট’ কথাটা ক্রিয়া বা কাজের সঙ্গে জড়ানো। সেই একই ধাতু মূল থেকে ছিটকে ওঠে অ্যাক্টর বা অভিনেতা। নানা রকম সময়, চিন্তা-খণ্ড, ক্রিয়া সমাবেশ-কে যে একই সঙ্গে ধরে রাখে শরীরে, সে-ই অ্যাক্টর বা অভিনেতা। বক্ষ্যমান বইটির কথানায়ক এক জনই। তার কাজ নানা রকম কুহক ভেদ করে নিজেকে ‘উপস্থিত’ বা হাজির করা। অনেক অনুপস্থিতির মূল্য চোকানো। সময়টাকে নিজের মধ্যে ধরে রাখা।
এই বই শুরু হয়েছে সেই হাস্যময় উপস্থাপকের সূত্রে। শেষ হয়েছে বর্তমানে ফিরে এসে আর এক অভিনেতার হাসি নিয়ে। এই হাসি খুব সুখের নয়। এই সহস্রাব্দে পৌঁছনোর ঠিক আগের দশকে আমাদের আধুনিকতার সৌধগুলি একে একে ভেঙে পড়ছিল। আর ভারতবর্ষের বাস্তবে উদার অর্থনীতি মিশে গেল চূড়ান্ত গণহত্যার উৎসবে। একই সঙ্গে কমোডিটি বা পণ্যবিলাস মিলে গেল কমিউনিটি বা গণবিনাশে। এই বইয়ের প্রস্থানভূমি সেই আশ্চর্য দশক! কী ভাবে পৌঁছলাম আমরা এই অবিশ্বাস্য বাস্তবে তারই একটা মানচিত্র এঁকেছেন শিবাজী। সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ‘রিডার’ হিসেবে আমাদের কৃতজ্ঞতা রইল তাঁর কাছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.