এক দিনে দু’টি ধাক্কা খেল কামদুনি। ওই গ্রামের ধর্ষিত ও নিহত কলেজছাত্রীর কাকা শুক্রবার সকালে মারা গিয়েছেন। আর ধর্ষণ-খুনের তদন্ত বিশেষ কোনও সংস্থাকে দিয়ে করাতে কামদুনি যে-আর্জি জানিয়েছিল, এ দিনই তা খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম
|
মৃত সাক্ষী |
কোর্ট। ছাত্রীর কাকার মৃত্যুতে কামদুনি মামলা জোর ধাক্কা খেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, তিনিই ছিলেন এই মামলার প্রধান সাক্ষী।
৭ জুন, ঘটনার দিন কলেজ থেকে ফেরার পথে ছাত্রীটিকে বাস থেকে নামতে দেখেছিলেন ওই কাকাই। বলেছিলেন, “সাবধানে যাস।” আত্মীয়দের মধ্যে তিনিই মেয়েটিকে শেষ দেখেছিলেন। ওই সাক্ষীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে কামদুনি।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মঙ্গলবার কলকাতায় বিচার ভবনের সামনে বিক্ষোভের সময় পুলিশের হাতে বেদম মার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন ছাত্রীর কাকা। তাঁকে আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তাঁর চিকিৎসায় গাফিলতি দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ। আর জি করের অধ্যক্ষ জানান, একটি কমিটি গাফিলতির অভিযোগের তদন্ত করছে। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি হবে।
এ দিন প্রধান সাক্ষীর মৃত্যুর খবর পেয়ে কামদুনির বহু বাসিন্দা হাসপাতালে জড়ো হন। তাঁদের বিক্ষোভ সামলাতে বিরাট পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়। বিকেলের মধ্যে ময়না-তদন্ত শেষ হলেও মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের দাবি ছিল, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট না-দেখানো পর্যন্ত তাঁরা দেহ নেবেন না। এতে উত্তেজনা বাড়ে। শেষ পর্যন্ত বিকেল সাড়ে ৫টায় মৃতদেহ নিয়ে কামদুনির রওনা হন আত্মীয়-গ্রামবাসীরা। রাতে শেষকৃত্য হয় কেওড়াতলা শ্মশানে।
ওই সাক্ষী জখম হলেন কী ভাবে?
কামদুনিবাসীর অভিযোগ, ১০ সেপ্টেম্বর বিচার ভবনে বিক্ষোভ-অবস্থানের সময় পুলিশ তাঁদের উপরে চড়াও হয়। নিহত ছাত্রীর এক ভাই বলেন, “অবরোধের শেষে গাড়িতে ওঠার সময় পুলিশ আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশ কাকাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। ঘুষি, লাথি মারে।” ছাত্রীর আত্মীয়দের প্রশ্ন, “এত গুরুত্বপূর্ণ মামলার প্রধান সাক্ষী কেন নিরাপত্তা পাবেন না?”
ওই সাক্ষীকে দু’দিন পরে, বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ২টো নাগাদ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মারা যান। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন গ্রামবাসীরা। কী সেই অভিযোগ?
কামদুনিবাসী জানান, মঙ্গলবার বাড়ি ফিরে ওই সাক্ষীর বুকে-পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। পরের দিনটাও কাটে প্রায় একই ভাবে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টা থেকে ব্যথা বাড়তে থাকে। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃতের ভাইপো এ দিন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বলেন, “কাকাকে ইমার্জেন্সিতে আনার প্রায় ৪০ মিনিট পরে ডাক্তার দু’টো ইঞ্জেকশন দেন। তাতেও ব্যথা কমেনি। সে-কথা ডাক্তারকে জানানো হয়।” তার পরে তাঁকে পাঠানো হয় ইসিজি-র ঘরে। একটা ওষুধ দেওয়া হলেও তিনি খেতে পারেননি। ওই সাক্ষীর ভাইপো বলেন, “আমরা ভর্তি করতে বললেও তা করা হয়নি। এ দিন ভোরে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে কাকা মারা যান।” মৃতের ১১ বছরের ছেলের অভিযোগ, “পুলিশই বাবাকে মেরে ফেলল।”
ইমার্জেন্সিতে ওই সাক্ষীর ইসিজি, রক্ত ও রক্তচাপ পরীক্ষা করা হয়েছিল বলে জানান আর জি করের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যাল। তিনি বলেন, “এ-সব করতে আড়াই-তিন ঘণ্টা তো লাগবেই।” এমন গুরুতর অসুস্থ রোগীকে ভর্তি করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করা বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা হল না কেন? অধ্যক্ষের উত্তর, “কোনও গাফিলতি হয়েছে কি না দেখতে মেডিসিনের প্রধান অপূর্ব মুখোপাধ্যায়, সার্জারির প্রধান গৌতম ঘোষ ও কার্ডিওলজির প্রধান প্রণবকুমার বিশ্বাসকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তাঁরা রিপোর্ট দেবেন। কারও দোষ প্রমাণিত হলে শাস্তি হবে।”
অভিযোগ মানতে চায়নি পুলিশ। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, “ময়না-তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী মৃতের শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। হৃদ্রোগে (কার্ডিওজেনিক শক) মৃত্যু হয়েছে।” রাজীববাবুর বক্তব্য, অবরোধ তুলতে যতটুকু শক্তি প্রয়োগ করা দরকার, সে-দিন সেটাই করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “গ্রেফতার ও আহতের তালিকায় ওই ব্যক্তির নাম ছিল না। তবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এসেছে। তদন্ত করছি।”
সাক্ষীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সিআইডি-র এক কর্তা জানান, কোর্টে সাক্ষ্য দিতে আসা-যাওয়ার সময় সাক্ষীরা পুলিশের হেফাজতেই থাকেন। অন্য সময় সাক্ষীকে নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের কাজ নয়। কিন্তু ‘অন্য সময়’ যদি সাক্ষীরা কোনও ভাবে আক্রান্ত হন? ওই বড়কর্তা এর কোনও উত্তর দেননি।
স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন ওই সাক্ষীর স্ত্রী। তিনি জানান, ১০ তারিখের পর থেকেই উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থাতেও দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ডের পরিণতি নিয়ে খুব কৌতূহল ছিল। রায়টা অবশ্য জেনে যেতে পারলেন না। |