বেশি রাতে ঘুম ভেঙেছিল বছর এগারোর সঙ্গীতার। চাদর আনতে ভাই বাদলের সাহায্য নিয়ে ঘরের দরজা খুলতেই আঁতকে ওঠে সে। বারান্দায় পড়ে মা রাখি হাজরার (৩০) মুণ্ডহীন দেহ। ছুটে কাছেই মামার বাড়িতে গিয়ে খবর দেয় সে।
খানিক পরেই এক ফুট তিন ইঞ্চির রক্তমাখা হাঁসুয়া হাতে কাটোয়ার এসটিকেকে রোড ধরে যেতে গিয়ে দাঁইহাট মোড়ে পুলিশের টহল গাড়ির হাতে ধরা পড়ে রাখির স্বামী জয়ন্ত হাজরা। পুলিশের দাবি, নিজেই ধরা দিয়েই জয়ন্ত বলে, ‘নিজের বউকে খুন করেছি। মাথাটা আছে ঘোষপাড়ার সুদেব ঘোষের বাড়িতে। আপনাদের কাছেই যাচ্ছিলাম।’ শুক্রবার ভোরে পুলিশ ধড় ও মাথা তুলে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বর্ধমানে কাটোয়া থানার রামদাসপুর গ্রামের হাজরাপাড়ার ঘটনা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বছর পনেরো আগে কাটোয়ার কুয়ারা গ্রামের জয়ন্তর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রাখির। এর দু’বছর পর থেকে জয়ন্ত শ্বশুরবাড়িতেই থাকত। ছ’বছর আগে রামদাসপুরে জমি কিনে বাড়ি করে সে। বছরখানেক ধরে সুদেব ঘোষ নামে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে সে দিনমজুরের কাজ করত। তার বাড়িতেও সুদেবের যাতায়াত ছিল। সুদেবের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করছিল জয়ন্ত। |
তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ঝগড়া হতে-হতেই জয়ন্ত হাঁসুয়া দিয়ে রাখির গলায় কোপায়। তার পরে প্লাস্টিকের প্যাকেটে কাটা মুন্ডু ভরে কয়েকশো মিটার হেঁটে সুদেব ঘোষের বাড়ির বারান্দায় একটি থামের পাশে রেখে আসে। সুদেববাবুর বাড়ির লোকজন জানান, ভোরে তাঁরা মাথাটি খোলা অবস্থাতেই পড়ে থাকতে দেখেন। এ দিন সকালে গ্রামে গেলে রাখির ছেলেমেয়ে সঙ্গীতা এবং বাদলই মাটির বারান্দা, পাটকাঠির দেওয়াল, অ্যাসবেস্টসের চালের নীচে লেগে থাকা শুকনো রক্তের দাগ দেখায়। সঙ্গীতা বলে, “আমি আর ভাই ঘরে পড়ছিলাম। বাবা ঘরে মদ খাচ্ছিল। মদ খাওয়া নিয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া হচ্ছিল। এর মধ্যেই রাতের খাবার না খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক রাতে উঠে দরজা খুলতেই দেখি মা পড়ে রয়েছে। মাথাটা নেই। চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বাবাও নেই।”
দুপুরে কাটোয়া আদালতে তোলা হলে জয়ন্ত বলে, “আমার বউ প্রায়ই রাস্তাঘাটে-বাড়িতে সুদেবের সঙ্গে গল্পগুজব করত। তা নিয়ে পাড়ার লোক আজেবাজে কথা বলত। তা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল। মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। খুন করে ফেললাম।” তবে গত তিন মাস সুদেব তাঁদের বাড়ি যাননি বলেও তিনি জানিয়েছেন। সুদেববাবু বলেন, “মাস দুয়েক আগে জয়ন্ত আমাকে ওদের বাড়িতে যেতে বারণ করে। বলে, লোকজন বাজে কথা বলছে। তোমার সম্মান নষ্ট হচ্ছে। এর পর থেকে আমি আর ওদের বাড়ি যাই না।” সুদেবের স্ত্রী সুজাতা দেবী বলেন, “সন্দেহের বশে আমাদের ফাঁসানোর জন্যই জয়ন্ত মুন্ডুটা বাড়িতে রেখে দিয়ে গিয়েছে।”
প্রতিবেশীদের একাংশ জানান, প্রায়ই বাড়িতে মদ খেত জয়ন্ত। মাঝে-মধ্যে বন্ধুদের নিয়েও বাড়িতে মদের আসর বসাত। বাড়িতে অশান্তি হত। মৃতার পড়শি-পরিজনদের মধ্যে রীতা হাজরা, বেলি হাজরা, বন্দনা হাজরার দাবি, “মাঝে মাঝেই জয়ন্ত বলত, রাখিকে খুন করার পরেই আমার শান্তি।” কাটোয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করে রাখির বাবা অজিত হাজরা বলেন, “ছেলে-মেয়ের কথা ভুলে সন্দেহের বশে কেউ এ রকম ঘটনা ঘটাবে ভাবতেই পারছি না।” বছর দশেকের বাদল কেঁদে ফেলে, “মাকে তো আর ফিরে পাব না।”
কাটোয়া আদালতের ভারপ্রাপ্ত এসিজেএম উদয় রানা এ দিন জয়ন্তকে ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কোনও আইনজীবী তার হয়ে সওয়াল না করায় আইনি পরিষেবা কমিটিকে বিষয়টি দেখতে বলেন তিনি। বর্ধমান জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, ধৃতের কাছ থেকে অস্ত্র ও রক্তমাখা প্যান্ট পাওয়া গিয়েছে। ওই দম্পতির মেয়ের গোপন জবানবন্দি নেওয়ার জন্য আমরা বিচারকের কাছে আবেদন জানাব। আশা করি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চার্জশিট পেশ করে কাস্টডি ট্রায়াল শুরু করা যাবে।” |