ভারতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে যতই বিশদ এবং তীব্র আলোচনা হোক না কেন, প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কেউই বিশেষ মাথা ঘামায় না, যদিও সেটাই শিক্ষা তথা কৃষ্টির প্রথম সোপান। ভারত তথা বাংলার কচি এবং কাঁচা ছেলেমেয়েরা গড়িয়ে গড়িয়ে মানুষ হয়, অত্যন্ত অভাব ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু এই নিদারুণ অবস্থার মধ্যেও গাঁ-গঞ্জের গরিব ছেলেমেয়েদের মেধার কোনও অভাব দেখি না।
দুঃখের কথা, ছোট শহরের বা গ্রামের ওই মেধাবী ছেলেমেয়েরা অনেকেই জীবনের মাঝরাস্তায় কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সুযোগের অভাবে, দারিদ্র আর সংসারের বহুমুখী চাপে ছিটকে পড়ে। আর এদের মধ্যে যারা আধসেদ্ধ শিক্ষার পরে রাজনীতিতে নেমে দাদাগিরি শুরু করে, তাদের সিংহভাগের কাজ হয় দেশকে ঠকানো। রাতারাতি বিরাট বিত্তশালী হয়ে ওঠে তারা। লেখাপড়া? কহতব্য নয়।
প্রাথমিক শিক্ষার মূল্য কতখানি, এশিয়ার অনেক দেশ কিন্তু সেটা ভাল ভাবেই বুঝেছে। জাপান তো সেই উনিশ শতকেই, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, চিন, তাইওয়ান, এরাও অনেক দশক আগেই। এই দেশগুলিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য সব থেকে উঁচু মাপের শিক্ষকদের ডেকে আনা হয় আদর করে, প্রচুর মাইনে দিয়ে। সেরা গ্র্যাজুয়েটরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটে আসে। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের কদর প্রচুর ওই সব দেশে, এমনকী তাঁদের কাজ ‘গ্ল্যামারাস’ বলেই গণ্য হয়। আমাদের দেশে অনেক দিন আগে এমনটা ছিল। মাইনে বেশি ছিল না ঠিকই, কিন্তু স্কুল-শিক্ষকদের সমাজে তখন যথেষ্ট সম্মান ছিল।
জাতীয় আয়ের অনুপাত বিচার করলে, ভারত সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় চিনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম খরচ করে। এর পিছনে আছে সামাজিক চিন্তাধারা, প্রাথমিক শিক্ষাকে যা তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয় না। প্রাথমিক শিক্ষাকে আমরা মনে মনে কোণঠাসা করে রেখেছি। অতি কঠিন অবস্থার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোয়। |
ছেলেমেয়েগুলো ক্লাস এইট-এর পর কাতারে কাতারে স্কুল ছেড়ে রুজি রোজগারের ধান্দায় নেমে পড়ে। ও দিকে টিউশনির উপদ্রব। প্রায়ই দেখা যায়, স্কুলের মাস্টারমশাইরা আগেভাগে ঘণ্টা দিয়ে ক্লাস শেষ করে বাড়িতে ছোটেন টিউশনির ক্লাস নিতে। এই টিউশনওয়ালারা ছাত্রদের বাবা-মায়েদের অবস্থা সঙ্গিন করে তুলেছেন। কান্দি শহরের একটি স্কুলের ছাত্রকে পদার্থবিদ্যা পড়াবার জন্যে তার কৃষিজীবী অভিভাবক দু’জন টিউটর নিয়োগ করেছেন। এক জন বাচ্চাটিকে অঙ্ক শেখান, আর এক জন ছবি এঁকে পদার্থবিদ্যার মাধুর্য বুঝিয়ে দেন। ভদ্রলোক বিদ্যালয়ের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য। সেই সূত্রেই আলাপ। দুঃখ করে বললেন, ‘আমি তো কিছু বুঝি না, কী করি বলুন, বাপ তো বটি।’ কিছু প্রশ্ন করার পরে ভদ্রলোক বলেই ফেললেন, ‘এর ওপরে সমাজের চাপ আছে। লোকে বলবে— ছেলেকে টিউশনিতে ভর্তি করোনি? কী রকম বাপ বাপু!’
উন্নত দুনিয়ায় তো বটেই, এশিয়ার অনেক দেশেও প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম এবং পদ্ধতি ঢেলে সাজানো হয়েছে। আর এখানে? আজ থেকে ষাট বছর আগে আমরা যে ভাবে স্কুলে পড়াশুনা করতুম, আজকের পদ্ধতি বা মাধ্যম মোটামুটি একই। পরিণাম? একটি নিদারুণ উদাহরণ দিই। বেশ কিছু দিন আগে উত্তর কলকাতায় যে স্কুলে পড়াশুনা করেছিলুম, সেখানে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য গেছি। যা দেখলুম, তাতে চক্ষু চড়কগাছ। বাচ্চাদের মায়েরা স্কুলের বারান্দায় মেঝেয় বসে আছেন, হাতে ‘এ ফোর’ কাগজের দিস্তা। কানে এল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর: ‘আচ্ছা শোন, আমি আজ অঙ্ক, তুই বাংলা, কেমন?’ ছেলেগুলি হইচই দৌড়াদৌড়ি করছে, মায়েরা পরীক্ষা দিচ্ছেন কিংবা নিচ্ছেন। ওরে বাপরে!
অথচ পুথিগত বিদ্যার ওপর খুব বেশি নির্ভর করে খুব একটা লাভ হবে না। দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, পুথিগত বিদ্যা নিয়ে বড় হয়ে ছেলেপুলেরা আসল জগতে খুব একটা সুবিধে করতে পারে না। কিন্তু বাবা-মায়েরা সেটা ভেবে দেখেন না, ‘ছেলে অনেক রাত জেগে লেখাপড়া করছে’, এতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। কী পড়ছে, মাথায় কিছু ঢুকছে কি?
হরদম শুনি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ‘ঢেলে সাজতে হবে’। তা, কী করতে হবে সে জন্য? আজকের পৃথিবীতে পুথিগত বিদ্যার ভাণ্ডারের অভাব নেই। ইন্টারনেট-এ সব তথ্যই মোটামুটি পাওয়া যায়। হলফ করে বলতে পারি, সাধারণ স্কুলের পাঠ্য বইগুলির তুলনায় ইন্টারনেটের তথ্য অনেক আধুনিক, ভুলভ্রান্তি কম। কিন্তু উঁচু মাপের শিক্ষা পুথি কিংবা গুগ্ল থেকে ঝরে ঝরে পড়ে না। গভীর ভাবে বোধগম্য হলেই শিক্ষা, তার পরে কৃষ্টি ও সমাজ।
আমাদের শিক্ষাজগতে বাচ্চাদের যত অবান্তর তথ্য গিলিয়ে খাওয়ানোর একটা ভীষণ প্রবণতা আছে। তথ্য গেলো আর পরীক্ষায় উগরে দাও— এই হল প্রাথমিক শিক্ষার মূল ধর্ম। কাঁড়ি কাঁড়ি নাম আর সাল-তারিখ মুখস্থ করাটা কোনও শিক্ষাই নয়, ওতে মগজে জঞ্জাল বাড়ে, কোনও কাজে লাগে না। প্রাথমিক শিক্ষা মানে নিজের চিন্তাভাবনার ভিতটা তৈরি করে দেওয়া। আর কিছু না হোক, বড় বড় পরীক্ষার বোঝাটা একটু কমান। বছরের শেষে পরীক্ষা না নিয়ে সাপ্তাহিক পরীক্ষা অনেক ভাল। পরীক্ষার ভয়ানক ভীতি কাটিয়ে উঠতে হবে। ওরা যেন উপলব্ধি করতে পারে যে, শিক্ষালাভ আনন্দের, ভয়ের নয়। গানবাজনা, আলোচনা, খেলাধুলো, সবই হোক। শিক্ষাই তো কৃষ্টির কাঠামো। সবার আগে ভাল মাস্টারমশাই চাই। সেরা মাস্টাররা ম্যাজিক ফলাতে পারে।
ম্যাজিকটার রহস্য কিন্তু আসলে খুব দুর্বোধ্য কিছু নয়। কেবল ছেলেমেয়েদের নতুন করে, নিজের মতো করে ভাবতে শেখাতে হবে। আমার দৃঢ় ধারণা, ছেলেমেয়েরা, বিশেষত পল্লিগ্রামের ছেলেমেয়েরা এ ব্যাপারে খুবই পটু। তাদের সেই স্বাভাবিক মেধাকে নষ্ট করে না দিলেই সোনা ফলবে। অথচ আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা হল, ‘ছেলেপিলেদের নিজের মতো ভাবতে দেওয়া ঠিক নয়, মানুষ হবে না।’ শিক্ষক, অভিভাবকরা এমনটাই মনে করেন। তাই বলি কী, মায়েরা ছেলেমেয়েদের অস্বাভাবিক আদর থেকে মুক্তি দিন, বাবারা পরম রক্ষণশীলতা থেকে তাদের উদ্ধার করুন। আতুপুতুকে বিদায় দিন, লাগাম ছাড়ুন। কম বয়স থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না শিখলে ছেলেমেয়েরা কোনও দিনই দাঁড়াতে পারবে না।
আর একটা কথা। সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে’, সেই কথাটা আজও সমান মূল্যবান। মাছের ঝোল আর ভাত ছাড়াও বিশ্বদুনিয়ার সভ্যতার স্বাদ ছোট বয়সেই মজ্জাগত করতে হবে। চিন্তা এবং ধ্যানধারণার পরিধি হোক সারা পৃথিবী। আমার কর্মজগতে ছেলেমেয়েদের যখন জোর করে সুইটজারল্যান্ডে সার্ন-এ পাঠাতে তৎপর হলাম, গ্রামাঞ্চলের মা-বাবাদের কী আশঙ্কা, কত আপত্তি! কিন্তু আজ তারাই সেরা ছাত্র। দুনিয়ার স্বাদ পেয়েছে, না? |
ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক |