সম্পাদকীয় ২...
বহিবারে দাও শকতি
বালক নরেন্দ্রনাথ দত্ত নাকি এক বার বৈঠকখানায় রাখা বিভিন্ন জাতের মানুষের জন্য রক্ষিত বিভিন্ন হুকা টানিয়া দেখিতেছিলেন, জাত বস্তুটি সত্যই ‘যায়’ কি না, গেলে কী ভাবে যায়। সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি জাতীয় পতাকার মর্যাদাহানি লইয়া যে জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের হইয়াছে— তাহা জানিয়া আজিকার কোনও শিশু বিবেকানন্দও বিস্ময়াহত পরীক্ষানিরীক্ষায় নামিতে পারেন, ‘জাতীয়তা’ বস্তুটির মর্যাদা কতখানি ভঙ্গুর তাহা হাতে-কলমে বুঝিতে। জাতীয় পতাকা দেশের নাগরিকের নিকট সম্মানের বস্তু। কিন্তু সেই সম্মানকে নিরাপত্তার প্রবল ঘেরাটোপের মধ্যে রাখিয়া চব্বিশ ঘণ্টা অতি সাবধানে রক্ষা করিবার ভাবনা হাস্যকর। কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটিলেই পতাকার সম্মান, জাতীয় মর্যাদা সব ধূলিলুণ্ঠিত হইল বলিয়া হাহাকার নিছক ছেলেমানুষি। বরং ইহাদের গুরুত্ব না দিলেই জাতীয় মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টও প্রশ্নটি তুলিয়াছে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকিয়াও একটি প্রতিপ্রশ্ন তোলা যায়: হিমালয়প্রমাণ বকেয়া মামলায় ডুবন্ত অবস্থাতেও আদালত এমন অকিঞ্চিৎকর ‘জনস্বার্থ’ মামলা কেন গ্রহণ করে?
প্রশ্নটি গুরুতর। ক্রিকেট খেলার মাঠে দর্শকাসন হইতে জাতীয় পতাকার অবমাননা হইয়াছে: এই অভিযোগ-সমৃদ্ধ মামলাটি প্রথমে কলিকাতা হাইকোর্ট এবং তাহার পরে সুপ্রিম কোর্ট কেবল গ্রহণ করে নাই, সতর্ক আলাপ-আলোচনা বিচার-বিবেচনার পর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড, ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল ইত্যাকার সংগঠনের নিকট নোটিসও পাঠাইয়াছে। তাহাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হইয়াছে, কেন দর্শকদের আচার-আচরণের উপর কঠোর নজরদারি করা হয় না। খেলার মাঠে এই ধরনের নজরদারি আদৌ সম্ভব কি? দ্বিতীয়ত, যদি কেহ পতাকা লইয়া বাড়াবাড়ি করিয়াও থাকেন, তাহা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য কি না। কলিকাতা হাইকোর্টের রায় ছিল, আবেগবশত কেহ এমন করিলেও তাহাকে ইচ্ছাকৃত অপরাধের পর্যায়ে ফেলা যায় না। অবমাননার অভিপ্রায় না থাকিলে অবমাননা ঘটে কি না, ইহা একটি গভীর প্রশ্ন। ময়দানে যদি কেহ অসঙ্গত আচরণ করে, তাহাকে তর্জন করা যায়, প্রয়োজনে বহিষ্কৃতও করা যায়, কিন্তু মামলা ঠুকিয়া দেওয়া— চায়ের কাপে সুনামি নয় কি?
প্রাসঙ্গিক আইনটিই অবশ্য এই সুনামির বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছে। ১৯৭১ সালের প্রিভেনশন অব ইনসাল্টস টু ন্যাশনাল অনার অ্যাক্ট অর্থাৎ জাতীয় মর্যাদার অবমাননা বন্ধ করিবার আইন অতি-স্পর্শকাতর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের মতো অভিজ্ঞ গণতন্ত্রে কিন্তু জাতীয় পতাকা লইয়া এই বিপুল অন্ধ ভক্তি দেখা যাইবে না, সে সব দেশে টুকিটাকি নিত্যব্যবহৃত দ্রব্যে, পোশাকে-আশাকে, এমনকী অন্তর্বাসেও জাতীয় পতাকা হামেশাই হাজির। দুই দেশেই কিন্তু ‘জাতীয় ভাব’, ‘দেশীয় গৌরব’ ইত্যাদি কোনও অংশে কম নহে। জাতির মর্যাদা আর জাতির প্রতিনিধিত্ববাচক চিহ্নসমূহের গৌরবের মধ্যে তাহারা পার্থক্য করিতে জানে। সন্দেহ হয়, ভারতে জাতিগত আত্মপ্রত্যয়ের অভাবই এক ধরনের নিরাপত্তাবোধের অভাব তৈরি করে, আর সেই অভাবজনিত দুর্বলতার জন্যই ডাক পড়ে আইনি রক্ষাকবচের। ভারতীয় জাতীয়তার এমন আত্ম-লঘিমা দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ হয়তো তাঁহার পঙ্ক্তিটি নূতন অর্থে পুনরুচ্চারণ করিতেন: তোমার পতাকা তারে দাও যারে বহিবারে দাও শকতি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.