সম্পাদকীয় ১...
অনুগামী
নেতা শব্দটির মূলে রহিয়াছে নী ধাতু। অর্থাৎ, লইয়া যাওয়া যাঁহার কাজ, তিনিই নেতা। তিনি নায়ক, পথপ্রদর্শক, অগ্রণী, প্রধান। জনগণের মনের তিনি অধিনায়ক, কিন্তু সেই মনগুলির সম্মিলিত বাসনা তাঁহার মধ্যে মূর্তিমান হইলে মুশকিল। মানুষ যাহা চাহে, সেই পথে ধাবিত হওয়া নেতার কাজ নহে। নেতা যাহা চাহেন— তাঁহার মুখাপেক্ষী জনগোষ্ঠীর জন্যই তিনি যাহা চাহেন— সেই পথে মানুষকে চালিত করাই নেতার অভিজ্ঞান। ইহা গণতন্ত্রের চরিত্র-বিরোধী নহে, ইহাই গণতন্ত্রের শর্ত। গণতন্ত্র অবশ্যই বহুমতের, বহুস্বরের পরিসর, কিন্তু সেই পরিসরে নীতির যাথার্থ্য নির্ণীত হয়— নীতি নির্ধারিত হয় না। অনুগামীদের ভবিষ্যতের রাস্তায় পথ দেখাইয়া লইয়া যাইবার দায়িত্ব নেতার। বস্তুত, যিনি এই দায়িত্ব পালন করিতে পারেন, তিনিই নেতা। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী তেমনই নেতা ছিলেন। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের দাবি আমজনতা করে নাই। গাঁধী সেই পথে বিশ্বাস করিয়াছিলেন। তিনি গোটা দেশকে নিজের বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করিতে পারিয়াছিলেন। যখন তাঁহার ডাকে অন্যরা সাড়া দেন নাই, তখনও তিনি নিজের পথ হইতে বিচ্যুত হন নাই। দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে তিনি একাই হাঁটিয়াছিলেন। তাঁহার রাজনৈতিক উত্তরসূরি জওহরলাল নেহরু বহু ক্ষেত্রেই গাঁধীর পথ পরিহার করিয়াছিলেন, কিন্তু নিজের বিশ্বাসে অটল থাকিবার ক্ষেত্রে নহে। হিন্দু কোড বিল অথবা বৃহৎ শিল্পায়নের সিদ্ধান্ত— কোনওটিই তৎকালীন সমাজের দাবি ছিল না। বস্তুত, সমাজ তাহার বিপ্রতীপ অবস্থানে ছিল। নেহরু স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটিতে ভয় পান নাই। নির্ভীক না হইলে নেতা হওয়া যায় না।
আশঙ্কা হয়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘নেতা’ শব্দটির সংজ্ঞা, ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা, সকলই ভুলিয়াছেন। উদাহরণগুলিও বিস্মৃত হইয়াছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভরাডুবির পর তিনি বলিলেন, মানুষ যেমনটি চাহে, দলকে ঠিক তেমন ভাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে। অর্থাৎ, নেতা হইতে অনুগামীতে পর্যবসিত হওয়াই তাঁহার মতে একমাত্র পথ। তিনি তবে ২০০৬ সালের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও আর স্মরণ করিতে পারেন না, যিনি বাঙালির কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া শিল্পায়নের কথা বলিতে সাহস করিয়াছিলেন। তিনি বিশ্বাস করিতেন, সেই পথেই পশ্চিমবঙ্গের মঙ্গল। আজ তিনিই ‘জনগণের মনের মতো দল’ গড়িবার কথা বলিতেছেন! ২০০৬ সাল যদি সুদূর অতীত বলিয়া বোধ হয়, বুদ্ধদেববাবু বর্তমানের গুজরাতের দিকেও তাকাইতে পারেন। নরেন্দ্র মোদী তাঁহার নিজস্ব বিশ্বাসের পথে হাঁটিতেছেন। সেই বিশ্বাসের যাথার্থ্য ভিন্ন প্রশ্ন— মোদী কিন্তু রাজ্যবাসীকে, শিল্পমহলকে নিজের বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করিতে পারিয়াছেন। মাও জে দং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সম্ভাব্য সুফলে যে বিশ্বাস করিয়াছিলেন, তাহাও ভ্রান্তই ছিল। কিন্তু দেশের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস সঞ্চারিত করিবার যে কাজ নেতার, মাও তাহাতে সম্পূর্ণ সফল। বুদ্ধদেববাবুদের দ্বিতীয় মুশকিল, ‘মানুষের মনের মতো’ হইয়া উঠিবার খেলায় যিনি কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী, পশ্চিমবঙ্গের ময়দানে সি পি আই এম-কে তাঁহার বিপক্ষেই নামিতে হইবে। এই খেলায় জেতা বড় সহজ নহে।
বুদ্ধদেববাবু অবশ্য ফিরিয়া প্রশ্ন করিতে পারেন— তাঁহার বিশ্বাস আর মানুষের চাহিদা যে এক হইবে, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? সেই নিশ্চয়তা নাই। মানুষ সচেতন ভাবে যাহা চাহে, তাহাই একমাত্র নহে। মানুষের অবচেতনে যে চাহিদা ঘুমাইয়া থাকে, তাহাকে চিনিতে পারা, তাহাকে জাগাইয়া তোলাই নেতার কাজ। মানুষ কী চাহে, তাহা নেতার বিবেচ্য নহে— মানুষের চাহিদাকে কোন পথে চালনা করা উচিত, তাহা বোঝাই নেতার কাজ। বুঝিতে না পারিলে, দুর্ভাগ্য। অনুগামী হওয়াই তখন একমাত্র পথ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.