|
|
|
|
সৌমিত্রর অনভিনয়ের অভিনয় |
শক্তির ভাষায়, চরিত্রগুলো প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো একা। অথচ ছবিটা দারুণ দাঁড়িয়ে গিয়েছে। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
অতনু ঘোষের ‘রূপকথা নয়’ ছবির নামকরণের মধ্যেই চমৎকার শ্লেষ আছে।
নিত্যদিন যা ঘটছে চারিদিকে, বাড়ির অন্দরে উঠে আসছে টিভি বা কাগজ মারফত, পাড়া-বেপাড়ায় ঘুরছে মুখরোচক চর্চা হয়ে, সে সবকেই তিনি তাঁর কাহিনিতে এককাট্টা করে পেশ করেছেন। প্রায় এক আধুনিক রূপকথার চালে। যা রোজ ঘটছে, আমাদের চমকে দিচ্ছে আর বিপন্ন করছে। তার পর এক সময় এক অদ্ভুত ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় বিনোদনের উপকরণ হচ্ছে। আমরা তাদের অন্যের ল্যাঠা মনে করে নিচ্ছি। আমরা তো দিব্যি আছি। ট্র্যাজেডি শাস্ত্রে এই প্রতিক্রিয়ার একটা সুন্দর নাম আছে শাডেনফ্রয়ডা।
যে-সব ঝকমারি আর দুর্ঘটনাকে অন্যের গল্প ভাবা যাচ্ছিল, তাদেরই চৌকাঠ ডিঙিয়ে নিজের জীবনে ঢুকে পড়া নিয়েই ‘রূপকথা নয়’। অতনুর কাহিনির আকর্ষণ ও কৃৎকৗশল এই যে, তিনি এই সমাজবাস্তবের বিষয়টিকে বেঁধেছেন রহস্য-কাহিনির প্যাকেজে। মোচড় মোচড় আর মোচড়ে ছবিটা অবলীলায় থ্রিলার হয়ে ওঠে। অবশ্যই দর্শক বিপন্ন হন, আবার বিনোদিতও। খুব সহজ কাজ নয় কিন্তু। বাংলা ফিল্মে আর কেউ এটা করেন কি? ‘রূপকথা নয়’-এর গোটা বৃত্তান্ত জুড়ে একটা গভীর নৈতিকতাও বিস্তারিত হয়। নীতি ও দুর্নীতির একটা সংলাপই যেন ছবিটা। বোধ ও নীতির এই কণ্ঠস্বরটা অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ শিশিরের। অবসরের সময়টা যাঁর কাটে পাড়ার পার্কের এক বেঞ্চে বসে। ‘রূপকথা নয়’-এর রূপমঞ্চ, এই পার্ক এই বেঞ্চ। |
|
পাড়ার নানা জনই নিজের ফুরসত মতো কিংবা সমস্যামতো এই বেঞ্চে এসে বসে, শিশিরের সঙ্গে কথা ও ভাবনারা জড়িয়ে যায়। শিশির কারও মুশকিল-আসান হলেন, কারও মরমী-শ্রোতা। আর তিনিও এই সব চরিত্রদের যোগাযোগে জীবন দেখেন, সমাজ বোঝেন, এবং নিজের মতো করে বিনোদিত হন। পার্ক থেকে বাড়ি ফিরতে তাঁর দেরি হয়ে যায়। বউমার মুখ-ঝামটা খান।
শিশিরের এই রকম এক পার্কসঙ্গী হল সবে বিয়ে করে পাড়ায় আসা অহনা। যে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। তার পরামর্শর জন্য আসে ইস্কুলে অঙ্কের মাস্টার শাশ্বত। অহনা তো ইস্কুল অবধি ধাওয়া করে শাশ্বতকে। আবদার কী? না, ওর এক প্রাক্তন প্রেমিক সাজতে হবে।
এ হেন দৈনন্দিনের মধ্যে বজ্রপাতের মতো পাড়ায় ঘটে গেল একটা খুন। এক সকালে পাড়ার গলিতে মিলল এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের লাশ। কাগজ টিভির ব্যাপার-স্যাপার হঠাৎ করে আর অন্যের বালাই থাকল না। এক নির্মম বাস্তবের সঙ্গে একটা রহস্য-কাহিনিও জুড়ে গেল।
এইখান থেকে অহনার আদিখ্যেতাকে ছাপিয়ে আর একটি মেয়ের সমস্যাই গল্পের কেন্দ্রে এসে পড়েআইটি কর্মী সানন্দা, যে ওই মৃত ট্যাক্সি ড্রাইভারের গাড়ির শেষ সওয়ারি ছিল। ‘রূপকথা নয়’-এ ঘটনা, দুর্ঘটনা ও চরিত্রের বলতে গেলে শেষ নেই। খুনের তদন্ত শুরু হতে সব চরিত্র ও ঘটনাই ক্রমে এক বৃত্তে এসে পড়তে থাকে। কাহিনির গড়নই এমন যে, সবাই যেন সবাইকে জড়িয়ে ফেলছে কোনও না কোনও জটিলতায়। আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা ধার করে বলতে গেলে ‘প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো একা।’
সব চেয়ে বেশি একা হয়ে পড়েন এক সময় শিশির এবং অতি অবশ্য সানন্দা। ট্যাক্সি ড্রাইভার খুনের সন্দেহ যার ওপর। ওর সাহায্যে লাগতে গিয়ে আরেক বিপন্নতায় শাশ্বত। একা সেও। আর নিজের একাকিত্ব রচনার সহজাত প্রতিভা অহনার। নিজের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসঙ্গ করেছে ভালমানুষ বর প্রসিতকে। ‘রূপকথা নয়’-এর একটা জার্নালিস্টিক চেহারা ও মেজাজ আছে, এক ডকুড্রামা ধরন। কিছু কিছু সংলাপে ঠিক এই মুহূর্তকে বাঁধার চেষ্টা। ছবিটা দাঁড়িয়ে আছে চমৎকার কিছু অভিনয়, সুন্দর নির্দেশনা, চনমনে সুর ও গান, এবং দারুণ ক্যামেরার কাজের ওপর।
শিশিরের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ঠিক অভিনয় করেননি, উনিই শিশির। বিবেকবান ও রসিক সৌমিত্ররই চরিত্রের সম্প্রসারণ যেন শিশির। ওঁকে মনে রেখে এবং ওঁর জন্যই যেন এই চরিত্র পরিকল্পনা। এ হল সৌমিত্রবাবুর অনভিনয়ের অভিনয়। কমিয়ে রেখে অনেক বলা।
আমাকে মুগ্ধ করেছেন সানন্দার ভূমিকায় রাধিকা আপ্তে, শাশ্বতর চাপা স্বভাবের অভিনয়ে কৌশিক সেন। আহা, কী অপূর্ব চাহনি ও অভিব্যক্তি দু’জনের! বড্ড ভাল লেগে গেল গৌরব চক্রবর্তীর প্রসিত ও সোহিনী সরকারের অহনা। খুবই সম্ভাবনা দুই নবাগতর, তাকিয়ে থাকব। টাইপিস্ট বিশ্বনাথের রোলে জোর মানিয়েছে রাহুলকে।
সুরারোপে জয় সরকারের এবং চিত্রায়নে গোপী ভগতের কাজ আধুনিক ছবিটার অনেকখানি আধুনিকতার মূলে। গোপীর ক্যামেরায় মাঝে মাঝে হালকা ডিফিউজড থেকে শার্প ফোকাসে আসা রহস্যঘন ছবিটার এক অন্য মাত্রা। এক সময় ক্যামেরার ঝাঁকুনিও। সুজয় দত্তরায়ের সম্পাদনায় কাট টু কাট ছবির ঝাঁঝ এসেছে।
বেশ নতুন একটা কাজ করে দেখালেন অতনু। তবে রহস্যতদন্তের ছবিতে এত ঘটনা, দুর্ঘটনা, অতীত কাহিনির সমাপতন বিশ্বাসযোগ্যতায় টান ধরিয়ে দিতে পারে। অল্প সময় এবং স্বল্প পরিসরে এত কিছু ঠেসে ঢোকালে কাহিনি ও ছবির শ্বাসরোধ হয়। ডিটেলে খামতি ধরা পড়ে। আজকের দিনে চেকে কলম বুলিয়ে তিরিশ হাজার টাকাকে দু’লক্ষ তিরিশ হাজার সংখ্যা ও হরফে করা যায় কি না সন্দেহ। গল্পের নেশায় ঘটনার পর ঘটনা চেলে গেলে অবাস্তবতাও ভর করে বৃত্তান্তে। শাস্ত্রে যাকে বলে অতি-উর্বরতার বিশৃঙ্খলতা।
তবু শেষ অবধি ‘রূপকথা নয়’ কিন্তু অঢেল তৃপ্তি দেয়। অতনুর ‘অংশুমানের ছবি’ দেখে অবাক হয়েছিলাম ওঁর ক্ষমতায়। এ ছবি দেখে নিশ্চিন্ত হতে পারছি, উনি এক ভিন্নগোত্রের ট্যালেন্ট। উপরন্তু রহস্য-কাহিনি মনস্ক। রহস্যের ছবিতে ওঁর শৈলী ও দক্ষতা আরও পাকা হোক। আপাতত আকাঙ্ক্ষা এটাই। |
|
|
|
|
|