পুঁটি, চাঁদা, মৌরলা, গেঁড়ি-গুগলি, কীটপতঙ্গ আর ঘোলা, পাঁকাল মাটি। জ্যালজ্যালে মশারির মতো জাল হাতড়ে খোঁজ চলেছে ছোট্ট মিনের।
স্কুলপড়ুয়া কিশোরী থেকে বাড়ির বউরা, দিনভর নদী-নালা, খাঁড়ি, ডোবার জলে দাঁড়িয়ে মিন বা চিংড়ির চারা জোগাড়ের ছবি সুন্দরবনে পা দিলেই চোখে পড়ে। তবে, চোখ এড়িয়ে যায়, নিরন্তর জল ঘেঁটে তাঁদের হাজা ধরা আঙুল, পায়ের পাতায় বিনবিনে ঘা আর হাজারও স্ত্রীরোগ সমস্যা। সুন্দরবনের প্রায় ৬২ হাজার মেয়ে এমনই রোগে ভুগছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ হেল্থ রিসার্চ’ (ডিএইচআর)-এর সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট এমনই দাবি করেছে।
অভাব সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালে ওষুধ অমিল, চিকিৎসক ‘অনিয়মিত’, তাই মেয়েদের অনেকের ভরসা যে ক্যানিং, মন্দিরবাজার কিংবা গোসাবার ডাক্তারের চেম্বার, তা ওই রিপোর্টে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ক্যানিংয়ের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “শরীরটা প্রায় রোগের আঁতুড়ঘর করে ফেলেছেন ওই মহিলারা। অধিকাংশেরই সমস্যা স্ত্রীরোগ।” সুন্দরবনের ৫৩ শতাংশ মহিলাই নানা স্ত্রীরোগের শিকার, বলছে ডিএইচআর-এর রিপোর্ট।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পক্ষে ডাঃ পি.কে আহমেদ জানান, সুন্দরবনের সাতটি ব্লকের ৩৩টি দ্বীপের মহিলাদের উপরে সমীক্ষা করে ওই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। নদীর ঘোলা জলে দীর্ঘক্ষণ কোমর জলে ডুবে থাকার ফলেই বিভিন্ন অসুখ দানা বাঁধছে। এর মধ্যে শ্বেতস্রাবের আধিক্যই বেশি। জলবাহিত বীজানু বা দূষণের জন্য যোনিপথে সংক্রমণ হচ্ছে, এমন সম্ভাবনা তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে পরিচ্ছন্নতার অভাব। ওই এলাকার পরিচিত চিকিৎসক সুশান্ত মণ্ডল বলেন, “ওই মহিলারা স্যানিটারি ন্যাপকিন হিসেবে যে কাপড় ব্যবহার করেন, তা ঘাসে, বেড়ার ধারে শুকোতে দেন। তার উপর দিয়ে হেঁটে চলে পোকা। আবার সেই সব কাপড় ব্যবহারের ফলে সংক্রমণ হয়।”
সুষম খাদ্যের অভাব, অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং ক্রমাগত রোগে ভুগে মহিলারা অপুষ্টিতে ভুগছেন। স্বল্প ওজনের শিশু প্রসব করছেন। বয়স বাড়লেও ওই শিশুদের শরীরের গঠন পাকাপোক্ত হচ্ছে না। গড়ে উঠছে না রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
মন্দিরবাজার ব্লকের গাববেড়িয়ায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গত তিন বছর ধরে সুলতানপুরে মহিলা ও শিশুদের চিকিৎসার জন্য ‘মুক্তি’ বলে একটি হাসপাতাল চালাচ্ছে। সেখানে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের টানা তিন সপ্তাহ রেখে নিখরচায় চিকিৎসা করা হচ্ছে। রোগ-রুখতে ওই মহিলাদের সস্তায় স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলিরও চেষ্টা করেছিল ওই সংগঠন। দাম ছিল মাত্র ১৬ টাকা। কিন্তু তা কেনারও সামর্থ্য নেই সুন্দরবনের মেয়েদের।
সংগঠনের তরফে ভক্ত পুরকায়স্থ বলেন, “নৌকায় বিভিন্ন দ্বীপের মহিলাদের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করতে গিয়ে আমাদের কর্মীরা শুনেছেন, ওই টাকায় দু’কেজি খুদ (চালের গুঁড়ো) পাওয়া যায়।” ভক্তবাবু জানান, একটু সরকারি সাহায্য পেলে আরও কম দামে মহিলাদের হাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন তুলে দেওয়া যেত। কিন্তু রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “স্থানীয় পঞ্চায়েত এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে। তবে সরাসরি স্বাস্থ্য দফতর থেকে কিছু করা সম্ভব নয়।”
স্ত্রীরোগের আঁতুড়ঘর, সুন্দরবন তাই কোমর জলেই আমগ্ন! |